বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩

আল্লামা আব্দুল হাই চৌধুরী বংশিপ্পা ছিলেন একজন কিংবদন্তী শায়খুল হাদীস

amarsurma.com

ড. সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ:

শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাই চৌধুরী রহ. ছিলেন একজন কিংবদন্তী শায়খুল হাদীস। হবিগঞ্জ জেলার আজমীরিগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে আনুমানিক ১৯২৪ খ্রি. জন্মগ্রহন করেন। বাবা ক্বারী মৌলভি আব্দুল হামিদ চৌধুরী এবং মাতা মোছা. নজীবুন নেছা। শায়খুল হাদিস রহ. এর শিক্ষা জীবন গ্রামের মসজিদের মক্তব থেকে শুরু। সেখানে তিনি কুরআন মজিদের নাজেরা সমাপ্ত করেন। এরপর এলাকার ব্রিটিশ স্কুলে (অল্ড স্কীম) ভর্তি হয়ে তৃতীয় ক্লাশ পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। ব্রিটিশ স্কুল পাশ মানে তখনকার সময়ে শিক্ষিতজনের তালিকায় যুক্ত হওয়া যা বর্তমানের নবম শ্রেনী পাশের সমমান। পরবর্তীতে তাঁর বাবা তাঁকে হবিগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা রায়ধরে ভর্তি করেন। রায়ধর মাদরাসায় তিনি একাধারে জালালাইন শরীফ পর্যন্ত লেখা-পড়া করার পর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি দরসগাহ মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্রগ্রাম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং একাধারে দাওরায়ে হাদীস তথা শিক্ষা সমাপন করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় নিজ জেলা হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রায়ধর দারুল হাদীস মাদরাসা থেকে, যেখানে তিনি দীর্ঘদিন লেখা-পড়া করেছিলেন। তিরমিজি শরীফ পড়ানো থেকে তাঁর শিক্ষকতা জীবন শুরু। একবছর পর রায়ধর মাদরাসায় বুখারী শরীফের কিছু অংশ তাঁর ভাগে আসে। তখন থেকেই তিনি শায়খুল হাদীস। একাধরে ৮ বছর রায়ধরে শিক্ষকতা করেন। পরে একই জেলার ইমামবাড়ী দারুল হাদীস মাদরাসায় প্রায় ৪ বছর, উমেদনগর দারুল হাদীস মাদরাসায় ৮ বছর, পরবর্তীতে মুজাহিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আমিন উদ্দীন শায়খে কাতিয়া রহ. এর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম কাতিয়া মাদরাসার শিক্ষা সচিব পদে ২ বছর এবং পূণরায় ইমামাবাড়ীতে আরও ২ বছর শায়খুল হাদীস পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ খ্রি. সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৈয়দপুর হাফিজিয়া হুসাইনিয়া আরাবিয়া দারুল হাদীস মাদরাসার তখনকার মুহতামীম হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান (শাল্লার হুজুর) রহ. এর অনূরুধে সৈয়দপুর মাদরামায় আসেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ বছর সৈয়দপুর মাদরাসার শায়খুল হাদীস পদে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ৬২ বছর তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুরুই হয় শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। সোনালি যৌবন ও জীবনে জমতে থাকে পুণ্যের প্রাচুর্য্য। তিনি ছিলেন একজন সহজ সরল মানুষ। সারাদিন কিতাব মোতালা’আই ছিল তাঁর কাজ। আধ্যাত্মিক জগতের জীবন্ত একজন নমূনা ছিলেন তিনি। একজন খালিস আল্লাহওয়ালা ছিলেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষ তাঁর কাছে হাজির হত। তিনি সমস্যা সমূহের বর্ণনা দিয়ে এর উপযুক্ত সমাধা দিতেন। এতে মানুষ খুবই উপকৃত হত। তিনি ছিলেন যোগ্য ও দক্ষ একজন হাদীস বিশারদ। তাঁর বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনে দেশের অনেক শীর্ষ উলামায়ে কেরাম, শায়খুল হাদীস, মুফাচ্ছির, মুফতি, মাদরাসার মুহতামীম রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মুফাচ্ছিরে কুরআন শায়খুল হাদীস হাফেজ মাওলানা তাফাজ্জুল হক রহ. জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হযরত শাহজালাল। রহ. সিলেট এর শায়খুল হাদীস ও মুহতামীম মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, শায়খুল হাদীস মাওলানা শিহাব উদ্দিন রেঙ্গা, শায়খুল হাদীস মাওলানা ইমদাদুল হক হবিগঞ্জী, শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুর রহমান দীগলবাগ, বাহুবল মাদরাসার মুহতামীম শায়খুল হাদীস মাওলানা মুনির উদ্দীন, শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুর মালিক,শায়খুল হাদীস মাওলানা মকবুল হোসেন শ্রীমঙ্গলী, মুফাচ্ছিরে কুরআন মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, মুফতি সৈয়দ নুমান আহমদ, মরহুম হাফিজ মাওলানা সৈয়দ ফুজায়েল আহমদ, শায়খুল হাদীস মাওলানা সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক প্রমূখ। তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন শাস্ত্রের অনেক কিতাবের দরস দিয়েছেন। তাঁর যোগ্যতার বিকাশ বৃহত্তর সিলেটে ছড়িয়ে পড়ায় তাঁকে দেশের বিভিন্ন বড় বড় মাদরাসা থেকে স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য বার বার অফার আসে, তিনি তা প্রত্যখ্যান করেন। তাছাড়া বিভিন্ন মাদরাসা থেকে সপ্তায় ২/৩ দিন বরকতান বুখারি শরিফের দরস দিতে জোর আবদার আসলেও লোভ লালসাহীন বড় মনের বুজুর্গ কারও কোন আবদান গ্রহণ করেননি বরং তিনি আবদারের জবাবে বলতেন, একই ব্যক্তি বিভিন্ন মাদরাসায় হাদীসের দরস দেয়া মানে ছাত্রদের হক এবং কিতাবের হক সঠিকভাবে আদায় না করা। তাছাড়া তিনি আরও বলতেন আমাকে মাদরাসা একটি বিষয়ের উপর দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দিল আমি এর হক কতটুকু আদায় করতে পারছি তাও সন্দেহের বিষয়। তিনি আরও বলতেন আমি যদি অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়াতে যাই তাহলে হাদীস পড়ানোর জন্য নতুন নতুন যোগ্য উস্তাদ তৈরীতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। তিনি শুধু হাদীস বিষারদ ছিলেননা তিনি ছিলেন একজন যোগ্য বিচারক। অত্যন্ত সজাগদৃষ্টির ও তীক্ষ জ্ঞানের অধীকারী ছিলেন। তিনি। মাদরাসার যে কোন সমস্যা দেখা দিলে তিনি তাঁর দূরদর্শি ও জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টির তাৎক্ষনিক সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাধান দিয়ে নিষ্পত্তি করে দিতেন যা দেখে উপস্থিত সকলই খুশী হতেন। এমনি ১৯৯০ ও ১৯৯১ খ্রি. মাদরাসায় পৃথক দুটি ঘটনার সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান স্মরণযোগ্য। আমরা জালালাইন জামাতে পড়ি। বছরের শুরুতে ছাতক উপজেলার আব্দুল হাকীম নামের একজন ছাত্র আমাদের জামাতে ভর্তি হয়। একই শ্রেণীতে পড়ার সুবাদে ক্লাশের সকলের সাথে তার ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। হঠাৎ একদিন নামাজের পর আব্দুল হাকীম তার কিতাব হাতে নিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বলে দুস্ত আমি মাদরাসা থেকে চলে যাইতেছি। আমরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে জবাবে বলল! মুহতামীম সাবের কাছে তোমাদের গ্রামের রানাপিং মাদরাসার একজন ছাত্র আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, যা নিষ্পত্তিকৃত রানাপিং মাদরাসার গতবছরের একটা বিষয় মাত্র। আমাকে ঐ বিচার প্রার্থীর সাথে রানাপিং গিয়ে বিষয়টি সমাধান করে আসতে বলা হয়েছে। শুনে আমাদের শ্রেণীর সকলেরই কষ্ট লাগলো এবং প্রশ্ন আসলো একজন বাদীর হাতে আসামীকে যেতে দেয়া হচ্ছে কেন? তাছাড়া বিবাদী রাারাপিং মাদরাসা কোন কর্তৃপক্ষও নয়। তাছাড়া যে বিচার দিয়েছে তার কোন খারাপ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আমরা তাকে বাধা দিলাম এবং ক্লাশের সকল মিলে শায়খুল হাদীস রহ. এর কাছে বিষয়টি অবগত করতে তাকে নিয়ে গেলাম।
তিনি আমাদের কথা শুনে বিষয়টি নিয়ে মুহতামীম সাব ও নাজিম সাবের সাথে আলাপ করে একটা সমাধান দেয়ার আশ্বাস দিরেন। আমরা মহাখুশী। পরবর্তীতে মুহতামীমসাব রহ. বিচার প্রার্থীকে রানাপিং মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মাধ্যমে লিখিত কোন অভিযোগ নিয়ে আসতে জানিয়ে দিলেন। মাদরাসা ছুটির ঘন্টা বাজলো আমরা যার যার বাড়ীতে চলে এলাম। আসরের নামাজ পড়তে দরগাহ মসজিদে গেলে দেখা যায় আমাদের ক্লাসের প্রায় সকলই, সাথে আব্দুল হাকীম। নামাজ শেষে জানা গেল মাদরাসায় যে ছাত্র (রানাপিং এর) বিচার দিয়েছিল সে বাজারে আব্দুর হাকীমকে একা পেয়ে কিল ঘুঁষি মেরেছে। রাখে আল্লাহ মারে কে! বিচার প্রার্থী তার খারাপ উদ্দেশ্য হাসিল করে নিল। উত্তপ্ত হয়ে গেল গ্রাম। অমুকের চামড়া কী আর পিঠে থাকে, হউক না সে আমার ভাই, ভাতিজা, ভাগনা। ছাড় দেয়া যাবেনা। ২৪ ঘন্টার মধ্যে উপযুক্ত বিচার না পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে ঘোষনা দিল মাদরাসার সকল ছাত্র। পরের দিন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বা আসামীর অভিভাবকদের কোন তৎপরতা না দেখে মাদরাসায় ক্লাশ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। ঐদিন ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাদরাসায় অনাকাংখিত একটি ঘটনা ঘটে। কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে মাদরাসার আভ্যন্তরীন সমস্যার সুস্ঠু সমাধান করেন শায়খুল হাদীস রহ.। থেমে যায়নি ছাত্র আন্দোলন। পরের দিন বা ঐদিন সন্ধ্যায় আসামীর অভিভাবক, মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে নিয়ে আমাদের ক্লাশমেট হাফিজ জুবায়ের এর বাড়ীতে আহতের চিকিৎসা খরছসহ তাকে খুশী করা হয় এবং উপস্থিত সকলের কাছে মাফ চেয়ে ভবিষ্যতে তার মাধ্যমে এরকম ঘটনা না হওয়া মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। পরবর্তী বছর আমরা মিশকাত জামাতেের ছাত্র। ক্লাশমেট হাফেজ মাওলানা সৈয়দ জুবায়ের, মরহুম মাওলানা শফি, মাওলানা সৈয়দ আজিজুর রহমান (মুয়াজি), মাওলানা সৈয়দ শাফায়াত আহমদ (শভা)সহ আমরা পুরাতন ছাত্র ১৩/১৪ জন জালালাইন থেকে মিশকাতে উঠেছি। বছরের শুরুতে মিশকাতে ভর্তি হয়েছেন সুনামগঞ্জ থেকে আসা মাওলানা মোঃ আনোয়ার পাশা, মাওলানা আব্দুল বাসিত, মাওলানা আব্দুর রকিবসহ আরও ক’জন। জালালাইনের বছর নিয়োগকৃত নতুন শিক্ষককে ক্লাস না দেয়ার আবদার জানালে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সু-নজরে দেখেন এবং উক্ত শিক্ষককে মিশকাত শরিফে একটা ক্লাস দেয়া হয়। চলতি বছরের শুরুতে ঐ শিক্ষককে পূণরায় মিশকাতে ক্লাশ না দেয়ার জন্য সকল মিলে মাদরাসার সাবেক মুহতামীম হাফিজ মাওলারা মুতিউর রহমান রহ. এর নিকট পূনর্বিবেচনার আবদার জানালে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। আমরা মিশকাতের সকল ছাত্র শায়খুল হাদীস রহ. এর লজিংএ গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বিষয়টি পূণর্বিবেচনার জন্য আবদার জানাই। হুজুর রহ. আমাদেরকে সুন্দর ও সন্তুষ্টমূলক যে সমাধা দিয়েছিলেন তা আজও মনে পড়ে। কিছুদিন থেকে হুজুর অসুস্থ। সিলেটের একটি হাসপাতালে হুজুরকে দেখতে গেলাম। দোয়া চাইলাম। আজ হুজুর নেই আমাদের দোয়া চাওয়ার জায়গা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হুজুরের রেখে যাওয়া আমানত হাদীসের দরস, কালা কালা হাদ্দাসানার মর্মময় সেই স্মৃতি আমাদের জীবনে লালন করতে পারি। আমাদের উস্তাত যাঁরা দুনিয়ায় রয়েছেন তাঁদের দীর্ঘ হায়াত কামনা করছি। রাব্বে কারীম আমাদেরকে দ্বীনের খাঁটি মুজাহিদ বানাও এবং আমাদের আকাবির ও আসলাফের রেখে যাওয়া দ্বীন রক্ষায় এগিয়ে আসতে আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক: প্রিন্সিপাল, সৈয়দপুর সৈয়দিয়া শামছিয়া ফাযিল মাদরাসা

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: