শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:০৭ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩

`ঝপ ঝপাঝপ পলো বাওয়া’ শুধুই রবে স্মৃতি হয়ে

নাজমুল ইসলাম মকবুল : তলাবিহীন কলসী বা মটকার আদলে বাশ ও বেতের সংমিশ্রণে ছোট ছোট ছিদ্র রেখে শৈল্পিক কারুকার্যের মাধ্যমে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যে যন্ত্রটি তৈরি করা হয় সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তারই নাম ‘পলো’। সিলেটাঞ্চলে পলো দিয়ে মাছ ধরাকে বলা হয় পলো বাওয়া। সেকেলে যুগে কুটির শিল্পের মাধ্যমে তথা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন গৃহস্থালী ও সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুতের পাশাপাশি শুধুমাত্র পলো প্রস্তুত ও বিক্রয় করেও জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকেই। কর্মক্ষম নারী পুরুষ একাজ করলেও পরিবারের ছোট বড় প্রায় সকলেই একাজে সহযোগিতার পাশাপাশি প্রস্তুত প্রণালী শিখে ফেলতেন এবং উত্তরাধিকার সূত্রেই এসব কুটির শিল্পের শৈল্পিক কার্যে পারদর্শী হয়ে উঠতেন। পলোর সাথে বাঁশ-বেত দিয়ে পোনা মারার ‘ওছু’ পানি সেচের ‘সেওত’ ফাঁদে ফেলে মাছ ধরার হরগা, ডরি, ছাই, পুটিয়ারা, কুকা, ফুপি, ঠনা, ডাটিয়া, মাছ রাখার খলই, কাকরাইন, ধুছইন, গৃহস্থালী কাজের ডাম, ধাড়া, চাছ, উড়া, টুকরী, হের, পোরা, পেটু, ডালা, কুলা, চালনী, সেওত, উঘারের মতো অধিক পরিমান ধান রাখার জন্য টাইল, বাঁশের টাক, রাওয়াল, সেলফ, পানিচাং, বেতের চেয়ার, সোফা, ইজি চেয়ার, খাট-পালংক, টেবিল, টুল, বাক্স, ঝাপি, দোলনাসহ হরেক রকম সৌখিন জিনিস তৈরি করতেন এবং এখনও এর কিছু কিছু জিনিস নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে তৈরি করা হয়।
সেকেলে যুগে প্রায় প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই দু-একটি পলো থাকতো। পলো দিয়ে মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগী ধরে রাখার কাজেও ব্যবহার করা হতো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে পৌষ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুরু হয়ে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরার মহড়া। সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাওর, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে কয়েকদিন পূর্ব থেকেই দিন তারিখ ঠিক করে আশপাশের প্রত্যেক গ্রামের জনসাধারণকে দাওয়াত দেয়া হতো। নির্দিষ্ট দিনে বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সৌখিন মৎস শিকারীরা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জড়ো হতেন। জলাশয়ের এক প্রান্ত থেকে সকলে একই সাথে লাইন ধরে লুঙ্গী আটঘাট করে বেধে অথবা কাছা (পেছকুন্দা) মেরে এক সঙ্গে দল বেধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ‘ঝপ ঝপাঝপ’ শব্দে প্রতিযোগিতামূলকভাবে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু করতেন এবং ক্রমান্বয়ে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতেন সামনের দিকে। কাধে ঝুলানো থাকতো মাছ সংরক্ষণের যন্ত্র যাকে সিলেটী ভাষায় বলা হয় ‘খলইদড়ি’। অনেকেরই মাথায় থাকতো গামছা বাঁধা। চলতো পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক চাপ দেওয়া আর হৈ-হুল্লুড় করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে এগিয়ে যাওয়া। যেন এক নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় দৃশ্য। পলো নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের উপস্থিতি ও হৈ-হুল্লুড়ের কারনে জলাশয়ের পানিতে তুমুল নড়াচড়া হতো এক ধরণের জলকম্পনের মতো। এতে মাছেরা দিশেহারা হয়ে আত্মরক্ষার্থে দিগি¦দিক ছুটাছুটি শুরু করে দেয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়তো। কোন কোন সময় মাছ দিশেহারা হয়ে লাফ দিয়ে শুকনোতেও উঠে যেত। মহড়া চলাকালীন কারো পলোতে মাছ লাগলেই মাছ পলোর ভেতর নাড়া দিত। এতে বুঝা যেত শিকার এবার হাতের মুঠোয়। তখন পলোটিকে কাদা মাটির সাথে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখা হতো যাতে নিচের কোন দিকে ফাঁক না থাকে। কারণ, ফাঁক থাকলে সেদিক দিয়ে শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এরপর উপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনা হতো বাঙালীদের সবচেয়ে প্রিয় আদর্শ খাদ্য মাছটিকে। মাছ বেশি বড় হলে সাথে সাথে জেলে পলোর উপর চড়ে বসে যেতেন এবং সহপাটির সহযোগীতা চাইতেন। সহপাটি তথা পাশের জেলে তড়িৎ গতিতে এসে ধরাধরি করে মাছটিকে বাগে এনে খলইদড়ি দিয়ে গেথে কাধে ঝুলিয়ে নিতেন। আগেকার জেলেদের সাথে আলাপ করে জানা যায় অধিক বড় সাধারণত বোয়াল মাছই ধরা পড়তো এবং কোন কোন মাছ সারা পলোর ভেতর জুড়ে বসত। এছাড়া রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, ঘাগট, কালিবাউস, ঘনিয়া, পুটা, শইল, গজার প্রভৃতি মাছও ধরা পড়তো। জলাশয়ের ওপাশে গিয়ে পলো বাওয়া শেষ হবার পর যারা মাছ পেতেন তারা খুশিতে বাগ বাগ হয়ে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু যারা মাছ পেতেন না তারা গুমড়া মুখে পলো কাধে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। দৃশ্যটা অনেকটা হরিলুটের মতো। মাছসহ বাড়িতে গেলে বউ-বাচ্ছা পরিবার-পরিজনসহ সকলেই খুশি হতেন দারুন আর আচ্ছামতো ভাজি বা পাক করে খেতেন মজা করে। মাছ না পেলে বা কোন কারনে খেপ মিস করলে শুধু আফসোস করা ছাড়া গত্যন্তর থাকতো না। মাছ ধরতে যাবার সময় অনেকেই বিভিন্ন প্রচলিত পদ্ধতিতে ঠিক (আওনা) চাইতেন মাছ পাওয়া যাবে কি না।
বর্তমানে অনেক হাওর, খাল-বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী নালা হাওর খাল বিল ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাট। কোথাও কোথাও কিছুটা জলাশয় থাকলেও আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না এবং আগের অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। আমার ছোটবেলার দেখা অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য নদী-নালা, খাল-বিল ও দীঘি যাতে ঘটা করে পলো বাওয়া হতো এখন আর সে সবের অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে এর বেশির ভাগ জলাশয় লাটিয়াল বাহিনী পেশিশক্তির বলে দখল করে নিয়েছে অথবা ব্যক্তিগতভাবে কলে কৌশলে বৈধ বা অবৈধভাবে কব্জা করে কাউকে সেখানে নামতে দিচ্ছেনা। এছাড়া সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহারের ফলে দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ের মুল্যবান মৎস সম্পদ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ দুষণের ফলে মাছের ব্যাপক মড়ক এবং রোগব্যধিও মৎস সম্পদ ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে ভারত তার উজানের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ করার ফলে এদেশের অনেকগুলি নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যায় এবং অনেক নদ-নদী আজ বিলুপ্ত হয়ে সেসব এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে ও হচ্ছে। সে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের অতি মুল্যবান মৎস সম্পদ। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের অস্তিত্ব আগের মতো খুঁজে পাওয়া স্বপ্নই বলতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই ব্যক্তিগত বা যৌথ উদ্যোগে মৎস চাষে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের স্বাদ ফার্মের মাছে পাওয়া যায়না। কথায় বলে ‘‘মাছে ভাতে বাঙালী’’। বাঙালীরা কয়েকদিন মাছ না খেলে মন আকু বাকু করে। কারণ এতে বাঙালীদের একটা নাড়ীর টান রয়েছে। বর্তমানে মাছ কিনতে বাজারে গেলে মাছের দাম শুনে আঁতকে উঠতে হয়। উন্মুক্ত জলাশয়ের সুস্বাদু মাছতো পাওয়াই যায়না বরং ফার্মের মাছই একমাত্র ভরসা। এমন এক দিন আসবে হয়তো উন্মুক্ত জলাশয়ে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুধু স্মৃতি হয়েই রবে অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো চিনবেই না পলো দিয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়।
লেখকঃ সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: