শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪২ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩
সরেজমিন রাজনাও: সরকারি সুবিধা দেয়ার কথা বলে মেম্বারের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

সরেজমিন রাজনাও: সরকারি সুবিধা দেয়ার কথা বলে মেম্বারের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার/মাহমুদুল হক স্বপন: চৈত্রের মাঝামাঝিতে কৃষকের ধান অকাল বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার কারণে যখন মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার চলছে, ঠিক তখনই সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নাম করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নামে স্বজনপ্রীতি, টাকা আত্মসাৎ, চাল চুরিসহ নানা অপকর্মের খবর এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নাম করে সাধারণ ও অসহায় মানুষদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার জগদল ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার রাজনাও গ্রামের সাঞ্জুব আলীর ছেলে হেলাল আহমদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৬ জুলাই একই গ্রামের মৃত সুকুর মোহাম্মদের ছেলে সিজুল মিয়া বাদি হয়ে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে এই অভিযোগটি দায়ের করেন। জানা যায়, রাজনাও গ্রামের মৃত রহমান উল্লাহর ছেলে আব্দুল কাদির, রঞ্জিত দাস, লিটন দাস, জগলু মিয়াসহ আরো অনেকের কাছ থেকে ৫শত, এক হাজার ও দুই হাজার টাকা করে নিয়েছেন সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নাম করে। কিন্তু মেম্বার হেলাল আহমদ টাকা নিয়েও অনেককেই সেই সুবিধা দেননি। শুধু তাই নয়, ভিজিডি কার্ডের ৫শত টাকা ও ৩৮ কেজি চাল অনেককেই দেননি বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া মেম্বার হেলাল আহমদকে নারী লোভী, বদমাশ ও টাকা-পয়সা লোভী হিসেবেও উল্লেখ করেন সিজুল মিয়া। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে জানান, আমার দেয়া অভিযোগ শতভাগ সত্য, ৪নং ওয়ার্ডের সচেতন মহল তার দুর্নীতির বিষয়টি অবগত আছেন। এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে কোনো সদুত্তর পাইনি বিধায় আমি সুবিচার পাওয়ার স্বার্থে বাধ্য হয়েই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছি।
টাকা দিয়েও কোন সরকারি সুবিধা না পাওয়াদের অন্যতন হলেন রাজনাও গ্রামের মৃত তাহের আলী স্ত্রী নূরজাহান বেগম (৪০)। তিনি জানান, আমার স্বামী মারা যাওয়ার আগে নিজে মেম্বারের হাতে ৫শত টাকা তুলে দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন চলে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত তিনি কোন চাল পাননি। তিনি আরো জানান, মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করা হলে সে আমার নাম নেই বলে জানায়।
একই গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল কাদির (৭০)। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, আমাকে ৬ কেজি চাল ও ৫শত টাকা দিবে বলে ১ হাজার টাকা নিছে। গত চৈত্র মাসে টাকা নিলেও এখন পর্যন্ত আমি কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইনি, টাকাও ফেরত পাইনি।
টাকা নিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা না দেয়ার অভিযোগের পাশাপাশি দেয়ার রেকর্ডও আছে। ফলে সরকারের দেয়া ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’-র সুবিধা এখন জনপ্রতিনিধিরা মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করছেন। দিনমজুর হান্নান মিয়ার স্ত্রী রোশনা বেগম (৩৫) জানান, মেম্বার হেলাল আহমদ আমাকে ৬ কেজি করে চাল দিবে বলে ৫শত টাকা নিয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লেখ থাকা জন্ম তারিখ অনুযায়ি তার বয়স ৮০। সরকারের দেয়া ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’-র আওতায় তিনি এখন বয়ষ্কভাতা পাওয়ার উপযোগি হলেও মেম্বার হেলাল আহমদের চাহিদার টাকা না দেওয়াতে বয়ষ্কভাতা পাচ্ছেন না রাজনাও গ্রামের মৃত সুরুজ উল্লাহর ছেলে ওয়াব উল্লাহ। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ দেয়া আছে ১৮ অক্টোবর ১৯৩৭। পারিবারিক অবস্থা খারাপ থাকার পরও তিনি বয়ষ্কভাতা পাচ্ছেন না কেন-জানতে চাইলে তিনি জানান, মেম্বার হেলাল আহমদ আমার কাছে ২ হাজার টাকা দাবি করেছে, আমি তার চাহিদা মেটাতে না পারায় বয়ষ্কভাতা পাচ্ছিনা। তিনি আরো বলেন, আমি মেম্বারকে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি যে, যদি তোমাকে টাকা দিতে পারতাম, তবে আমিইতো সেই টাকা দিয়ে চাল এনে খেতাম; আমার কাছে টাকা নেই বলেইতো তোমাকে বলেছি। তাছাড়া সরকার এ সেবা আমাদেরকে ফ্রি দেয়ার জন্য দিয়েছে, টাকার বিনিময়ে নয়।
অনেকের কাছ থেকে জগদল ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার হেলাল আহমদ টাকা নিলেও ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। গ্রামের অনেকের কাছে অভিযোগ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তাদের মুখ বন্ধ। কারণ, পেছনে নির্যাতনের ভয় কাজ করে। এমনই একজন হলে রাজনাও গ্রামের লিটন কান্তি দাস (৩৪)। তিনি পেশায় হোমিও চিকিৎসক। ওয়ার্ড মেম্বার সুবিধা দেয়ার কথা বলে কোন টাকা-পয়সা নিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার কাছ থেকে কোন টাকা-পয়সা নেয়নি, শুনেছি অনেকের কাছ থেকে নিয়েছে। তবে আমাদের নাম কোথাও দেয়না উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, মেম্বার হেলাল আহমদ আমাদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে।
এছাড়া সরকারি টিউবওয়েল দেয়ার কথা বলে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে মেম্বার হেলাল আহমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রামে সরেজমিন সাংবাদিক আসছে জানতে পেরেই তিনি বিভিন্ন জনের কাছে মোবাইলে টাকা ফেরত দেবেন বলে হাতে-পায়ে ধরছেন, যাতে তার বিরুদ্ধ সাংবাদিকের কাছে কোন অভিযোগ তুলে না ধরেন। তবে ওই ব্যক্তি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।
রাজনাও গ্রামের গণ্যমান্য হাজী আব্দুল মতলিব মিয়ার ছেলে আব্দুর রব (৩২), মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে কফিল উদ্দিন (৩৫) এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, এক সময়ের অপরিচিত সেস্বার হেলাল আহমদকে শিক্কিত লোক মনে করে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছি। কিন্তু এখন দেখি তার কার্যকলাপ একজন মূর্খের চেয়েও খারাপ। তারা আরো জানান, এলাকার সাধারণ কৃষকের মুখের খাবার অকাল বন্যায় নিয়ে গেছে, এ নিয়ে মানুষ নানাভাবে চিন্তিত হলেও এই সুযোগে মেম্বার আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে চাচ্ছে; যা মানুষের সাথে চরম বেইমানির নামান্তর। তার এসব আচরণ নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে আমাদের দাবি হলো, সময় থাকতে সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সাধারণ ও অসহায় মানুষের কাছ থেকে নেয়া টাকা-পয়সার আনীত তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হোক।
মেম্বার হেলাল আহমদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিজের আত্মীয়-পরিজন, গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অবজ্ঞা ও অসম্মান করে আসছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, আমরা একটি শিক্ষিত ছেলে মনে করে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলেও এখন সে বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করাসহ সাধারণ মানুষের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করছে। আমরা তার আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিতেও মনে আঘাত পাই।
গ্রামের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রাজনাও গ্রামের একটি ঈদগাহ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মেম্বার হেলাল আহমদের কুটচালের কারণে আজো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া গ্রামের পয়েন্ট থেকে রতনগঞ্জ বাজার রাস্তায় নির্মিতব্য ব্রিজের পাশের রাস্তায় মাটি না কেটেই টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়া গ্রামের মধ্যে বিবদমান গ্র“পের মধ্যে নানা ধরণের ইন্ধন দিয়ে সমস্যা সমাধান না করে জিইয়ে রেখেছে, যা একজন জনপ্রতিনিধির জন্য কাম্য নয় বলেও সূত্রটি জানায়।
এ ব্যাপারে জগদল ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল আহমদ এ প্রতিবেদককে জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এলাকার একটি মহল অবৈধ সুবিধা নিতে চাচ্ছে। আমি তাদের অনৈতিক আবদার রক্ষা না করায় তারা আমার বিরুদ্ধে একটি মহলকে উস্কে দিচ্ছে। অভিযোগটি শতভাগ মিথ্যা উল্লেখ করে মেম্বার হেলাল আহমদ এ প্রতিবেদককে বলেন, যারা অভিযোগ দায়ের করেছে, তারা যদি প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমি পরিষদ থেকে পদত্যাগ করবো। এর আগেও বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছিল, কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।
দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে দায়ের করা অভিযোগের সত্যতা জানতে কল করা হলে মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার অফিসের লোকজন জানান, একটি প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান পাভেল দেশের বাইরে আছেন।
লেখাটির স্বত্ত্ব ‘আমার সুরমা ডটকম’ কর্তৃপক্ষের, এটির আংশিক বা হুবহু কোথাও অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যাবেনা।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: