বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:১৪ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩

কাতারের প্রতি বিশ্বে সমর্থন বাড়ছে

আমার সুরমা ডটকম ডেক্সসন্ত্রাসবাদ সমর্থন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্টের অভিযোগে গত ৫ জুন কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ করে সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ। এর পরই কাতারের পাশে দাঁড়ায় বিভিন্ন মুসলিম দেশ।

শুরুতে সৌদি মিত্রদের এই অবরোধকে সাময়িক মনে হলেও ধীরে ধীরে তা বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। কাতারের উপর কথিত অভিযোগে সৌদির এ অসহিষ্ণু অবরোধকে মোটেই ভালো চোখে দেখছে না বিশ্ব মুসলিমের বড় একটি অংশ। এমনকি এতদিন সৌদি যাদের ঘরোয়া মিত্র মনে করত, তারাও সৌদির এ অপরিণামদর্শী অবরোধের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এ অবরোধে শরীক হওয়ার আহবান জানালেও মূলত উপসাগরীয় মাত্র ৪টি দেশ ছাড়া সৌদির ডাকে সাড়া দেয়নি কোনো মুসলিম রাষ্ট্র।

এদিকে এই অবরোধের পরপরই কাতারে খাদ্য পাঠাতে শুরু করে তুরস্ক এবং ইরান। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের আগে কাতার অধিকাংশ খাবার উপসাগরীয় প্রতিবেশী আরব দেশসমূহ থেকে আমদানি করতো। এই অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি তুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেন, সবাই মিলে কাতারকে একঘরে করলে আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হবে না বরং সংকট বাড়বে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা কাতারের ভাইদেরকে ছেড়ে যাবেন না। সৌদির সঙ্গে সম্পর্কের চরম উত্তেজনার মধ্যেই কাতারে সেনা পাঠিয়ে যৌথ সামরিক মহড়াও চালিয়েছে তুরস্ক। ইরানও অবরুদ্ধ কাতারে নিয়মিত খাদ্য পাঠাচ্ছে। এসব খাদ্যের মধ্যে বেশিরভাগই থাকছে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল। এছাড়া কাতারকে সব রকম সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয় দেশটি। এমনকি কাতারের জন্য নিজেদের আকাশ মুক্ত করে দেয় ইরান। পরোক্ষভাবে কাতারের প্রতি সমর্থন রয়েছে পাকিস্তানের। রিয়াদ সফরে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙ্গে সরাসরি জানতে চান আপনারা কোন পক্ষে থাকবেন? জবাবে নওয়াজ জানান, আমরা কোনো মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে যাবো না।

এদিকে কাতার সঙ্কটে উদ্বিগ্ন ফিলিস্তিনিরা। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গাজা উপত্যকায় নতুন বাড়ি, হাসপাতাল ও সড়ক নির্মাণে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে কাতার। গাজার হামাদ সিটির অধিবাসীদের মধ্যে রীতিমত উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে এ সংকট, কারণ তারা মনে করছে বিষয়টি দীর্ঘায়িত হলে তারা হারাবেন তাদের একজন প্রধান দাতা ও সহযোগীকে। শেখ হামাদ সিটির একজন অধিবাসী বাহা শালাবি বলেন, ‘আমরাই আসলে ভিকটিম হতে যাচ্ছি।’ তার মতে, ‘অর্থ, সমর্থন, অবকাঠামো, ভবন নির্মাণ–সবকিছুই এবার বন্ধ হয়ে যাবে।’ হামাসের পার্লামেন্টারিয়ান ইয়াহইয়া মুসা বলেন, ‘কাতারকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে আরব বসন্তকে সমর্থন দেয়ার কারণে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সমর্থন করায় এই শাস্তি। কাতারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা আমাদের ভাইদের সাথে আছি।’ শেখ হামাদ সিটিতে এক সমাবেশে মুসা যখন এমন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন ফিলিস্তিনি শিশুরা কাতার ও ফিলিস্তিনের পতাকা নাড়াচ্ছিলো।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব সফরে এসে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্য দেশসমূহের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে অন্য সদস্য দেশসমূহকে প্ররোচিত করেন। ধারণা করা হচ্ছে কাতার সঙ্কটের মূল হোতা হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষায় মার্কিন-সৌদি জোট এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটে কাতারের প্রতি বিশ্বে সমর্থন বাড়তে থাকায় ভোল পাল্টেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চলমান সংকট নিরসনে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে হোয়াইট হাউজে বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। যদিও এর আগে তিনি দাবি করেন, সৌদি জোটের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে তার ভূমিকা আছে। কাতার সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়ন করছে বলেও বিশ্বাস করেন তিনি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন নিষেধাজ্ঞা শিথিলের দাবি তুলে বলেছেন, এ নিষেধাজ্ঞা দেশটিতে মানবিক সংকট তৈরি করবে। বিশেষত নিত্যদিনের খাদ্য পণ্যের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় দোহাকে। এমন পরিস্থিতি দেশটিকে তীব্র খাদ্য সংকটের মুখে ফেলবে।

কাতারের বিরুদ্ধে আনা সৌদি অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নয়ের্ত বলেন, ‘সময় যত যাচ্ছে সৌদিআরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সন্দেহ তত ঘণীভূত হচ্ছে।’ নয়ের্ত বলেন, কাতারের ওপর পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো দু সপ্তাহ আগে অবরোধ আরোপ করেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কাতার সরকারের কাছে কিংবা ওই এলাকার জনগণের কাছে অভিযোগের বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরে নি। এ অবস্থায় আরব দেশগুলোর তৎপরতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। মার্কিন মুখপাত্র বলেন, ‘ঘটনার এ পর্যায়ে আমরা সাধারণ একটি প্রশ্নই তুলছি আর তাহলো- সন্ত্রাসবাদের অভিযোগেই কী তারা কাতারের বিরুদ্ধে বর্তমান পদক্ষেপ নিয়েছে? নাকি পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি’র ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা টানাপড়েনের কারণে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে?’

এদিকে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল জানান, উপসাগরীয় দেশগুলোতে চলমান উত্তেজনা ও সংকটময় পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। বিরোধ নিরসনে ইরান ও তুরস্কসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সব দেশকে একযোগে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। মেক্সিকো সফরকালে তিনি বলেন, ‘চলমান কূটনৈতিক সংকটের কারণে গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ঐক্য বিনষ্ট হবে। তার আগে এ সংস্থাটিই যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিরোধ নিরসন করতে পারে।’ চলমান সঙ্কটের মধ্যেই কাতারকে ১৩ দফা শর্ত দিয়েছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো। প্রধান শর্তগুলো হলো-ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, আল-জাজিরা নেটওয়ার্ক এবং তুরস্কের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করা। এসব শর্ত মানার জন্য দোহাকে ১০ দিনের সময় দেয়া হয়েছে। ১৩ দফা শর্তের তালিকা কাতারের কাছে তুলে দেয় কুয়েত। সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে চলমান সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করছে দেশটি। ১৩ দফা শর্তের মধ্যে কাতারের প্রতি আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও রয়েছে। অবশ্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জানানো হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারকে এ অবরোধের মাধ্যমে মূলত সৌদি জোটই ক্ষতিগ্রস্থ হলো বেশি। মুসলিম বিশ্বে এ অবরোধের কারণে সৌদি জোটের প্রতি খারাপ ধারণা জন্ম নিয়ছে। বিশেষ করে একটি সার্বভৌম দেশকে ১৩ দফার যে শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তা সৌদি জোটকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে ফেলবে। কেননা একটি স্বাধীন দেশকে কোনোভাবেই ১৩ দফার ১ দফাও চাপিয়ে দেওয়ার কোনো রাষ্ট্রের নৈতিক অধিকার নেই। এদের শর্তগুলো দেখলে মনে হবে সৌদি জোট এই যুগে নয়; বরং মধ্যযুগে বসবাস করছে, যখন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো গায়ের জোরে তাদের ইচ্ছা আরেক দেশের উপর চাপিয়ে দিতো।

কাতারকে শর্ত দেয়া হয়েছে, এ ১৩ শর্ত গোপন রাখতে হবে। কিন্তু কাতার যখন সেগুলো ফাঁস করে দেয় তখন আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, কাতার আমাদের দাবিগুলো ফাঁস করে মূলত সংকট সমাধানের পথকেই রুদ্ধ করে দিলো। এ থেকে স্পষ্ট, সৌদি জোটের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য বিপ্লবের ভয় এখনো কাটেনি।

যখন মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে ইরান, রাশিয়া জোটের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ আর মার্কিন মূলুকের নেতৃত্বে সৌদি জোটের ক্ষমতার অপব্যবহারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই আগুনের কারাগারে রূপান্তর হয়েছে। ঠিক তখনি উদার ভাবাপন্ন মুসলিম রাষ্ট্র কাতারকে বয়কটের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের লেলিহান শিখাকে উষ্কে দেয়ার অভিযোগ শুধু সৌদি জোটের বিরুদ্ধে নয়, এ অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলাইলের উপরও।

রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে প্রাসাদ ক্যু এর মাধ্যমে বিন নায়েফকে সরিয়ে দেয়ায় এটি আরো স্পষ্ট যে, সৌদি জোটের এ অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তগুলো একান্তই সৌদি জোটের নয়, বরং এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি দুষ্টচক্রের সিদ্ধান্ত। কারণ আল জাজিরা বলছে, বিন নায়েফ দৃশ্যত কাতারের উপর বয়কটের বিরোধী ছিলেন। বিন নায়েফ সৌদি রাজ পরিবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়া সত্বেও খুব সহজেই সৌদি বাদশাহ তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও ক্রাউন প্রিন্সের চেয়ার থেকে সরাতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ইন্ধনে।

অপরদিকে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সৌদিজোটের আহবানে সাড়া না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার ভান করলেও এটিকে দেখা হচ্ছে কাতারের প্রতি সমর্থন হিসেবেই। মূলত ইসলামের আবির্ভাব ও তার রক্ষণাবেক্ষনের কেন্দ্রভূমি, রাসুল সা. এর জন্মভূমি, অপরাপর নবীদের আগমনস্থল ও বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে তীর্থ, পবিত্রস্থান মক্কানগরীর স্বার্থে সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ কটাক্ষ, ও রাষ্ট্রীও সমালোচনা, না করলেও বিপুল জনসমর্থন চলে গেছে সৌদির বিরুদ্ধে। এটিকে সৌদির নৈতিক পরাজয় হিসেবেও দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে উপসাগরীয় সৌদি জোটের ৪টি দেশেই কাতার নিয়ন্ত্রিত আল জাজিরা প্রদর্শন ও তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ হলেও বর্তমানে আল জাজিরা চ্যানেলের রেটিং বেড়েছে স্মরণ কালের সবচেয়ে বেশি। আল জাজিরা বলছে, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দাঙ্গা হাঙ্গামায় সৌদি জোটের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করে ইঙ্গ-মার্কিনি স্বার্থ সংরক্ষণে মরিয়া সৌদি জোটের প্রতি আক্ষেপ জন্মেছে বিশ্ব মুসলিমের। অপর দিকে কাতার বৈশ্বিক ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের এ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে একমত হতে না পারায় সৌদি জোটের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে কাতার। আর স্বভাবতই কাতারের এ রাষ্ট্রীয় নীতির সাথে আল জাজিরা একমত পোষণ করে নিউজ কাভার করলে দর্শকপ্রিয়তা পায় আল জাজিরা। সব মিলিয়ে এই অবরোধের ফলে সৌদি জোটই ক্ষতিগ্রস্থ হলো। এতে চাপে পড়েছে মার্কিন-ইসরাইল সমর্থিত সৌদি জোট।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: