বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০২:৩৭ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস: নিষ্ফল তদন্ত স্বজনদের মামলার

গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস: নিষ্ফল তদন্ত স্বজনদের মামলার

২০০৭ থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত গুম ৬১৪ । ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার । গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৬৭ জনকে । ফেরত এসেছে ৫৭ । ৩৮৫ জনের খোঁজ নেই

হাবিব রহমান:

রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর সেলিম রেজা পিন্টুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যান অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা। তাকে কালো কাচের একটি সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিখোঁজ সেলিম রেজা সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন। নিখোঁজের পর থেকে সেলিমের সন্ধানে তার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো ফল পায়নি।

এ ঘটনায় রাজধানীর পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা করে পরিবার। আদালতের নির্দেশে পল্লবী থানাপুলিশ ঘটনার তদন্ত করে সেলিম রেজাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার সত্যতা পায়। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ কারণে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট (সত্য) দাখিল করে পুলিশ।

পুলিশ চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে মামলার তদন্ত শেষ করলেও থেমে থাকেনি সেলিম রেজার পরিবার। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে তার পরিবার। কিন্তু কিছুতেই নিখোঁজ সেলিম রেজার সন্ধান পায়নি তারা। এখন শুধু অপেক্ষাই পরিবারটির যেন একমাত্র করণীয়।

সেলিম রেজা পিন্টুর বড় বোন রেহেনা বানু মুন্নি আমাদের সময়েকে বলেন, ‘আমার ভাই কোনো সন্ত্রাসী কিংবা ইয়াবা ব্যবসায়ী নয়। অসুস্থ রেজাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার ভাই বেঁচে নেই- সেটি আমরা বিশ^াস করি না। আমৃত্যু বিশ^াস করে যাব, আমার ভাই একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। সরকারের কাছে একটাই দাবি- আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।’

রেহেনা বানু মুন্নির করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, সেলিম রেজাকে তুলে নিয়ে যাওয়া গাড়ি নম্বর প্লেটবিহীন ছিল। এ কারণে গাড়িটি শনাক্ত করা যায়নি।

সেলিম রেজার পরিবার জানায়, গত ৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল সেলিম রেজার বাসায় যায়। সেলিম রেজার পরিবার এই প্রতিবেদককে জানায়, ডিবি পুলিশ এসে তাদের জানান, তারা সেলিম রেজার মামলাটি আবার তদন্ত করে দেখছেন।

শুধু সেলিম রেজা নয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের প্রতিটি পরিবারের গল্পই প্রায় এক। সবার একটিই চাওয়া- ফিরে আসুক তাদের প্রিয় স্বজন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকে, আবার কাউকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছে পরিবারগুলো।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস ঘিরে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির ঘোষণা করেছে। দেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে আসক এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৬৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৮৫ জনের কোনো হদিস নেই। তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই মানবাধিকার সংগঠন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।

মিরপুরের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে ২০১৯ সালের ১৯ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সন্ধানে সম্ভাব্য সব জায়গায় ঘুরেছেন ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান।

নিখোঁজ ইসমাইল হোসেনের নবম শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে আনিশা ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে বাবার সঙ্গে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতাম। অনেক বিষয়ে বাবার কাছে জানতে চাইতাম। বাবা সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে বলতেন। আমার সব আবদার ছিল বাবার কাছে। বাবা কাছে নেই দুই বছর। এই দুই বছর বৃষ্টি হলে আমি আর বারান্দায় যাই না। আমার শুধু কান্না পায়। বাবার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ঈদের দিন আরও বেশি কান্না পায়।’

এদিকে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জন ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠায়। সেই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুন পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) একটি চিঠি পাঠায়। ৩৪ জনের একটি তালিকা সংযুক্ত করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চাওয়াসহ চারটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছে এতে। চিঠি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর পাঠানোর পর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছেন মাঠপর্যায়ে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ এর আগেও গুম হওয়া একাধিক ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো সেসব চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় একাধিকবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। এমনকি মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় কাজ করতে দেশে আসতে চাইলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা গুমের ঘটনাগুলো সবসময় অস্বীকার করে আসছে সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসক নির্বাহী কমিটির মহাসচিব ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশে একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। সার্বিক আস্থাভাজন একটি কমিশন চেয়েছিলাম। যারা তল্লাশি করবে, অনুসন্ধান করবে এবং যারা গুমের সঙ্গে জড়িত – তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে। এ কথাগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমরা বলে আসছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- রাষ্ট্রের তরফ থেকে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তার পরপরই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি দীর্ঘ তালিকা প্রকশ করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা কিছু সুপারিশ করে। যেসব বাহিনীর সদস্যরা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনার সুপারিশ রয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মীদের চাওয়া আর জাতিসংঘের এই চাওয়া একই। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করছি না। এ জন্য আস্থা পাওয়ার মতো কিছু আমরা দেখছি না।

এদিকে, আন্তর্জাতিক গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান প্রতিরোধ দিবসের প্রাক্কালে গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে খুঁেজ বের করার দাবি জনিয়েছে আসক। প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে আসক। একই সঙ্গে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহির্প্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

জাতিসংঘ ২০০২ থেকে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে। ইংরেজিতে নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়, তাতে ৩০ আগস্টকে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষণা করা হয়। এর পর ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: