বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৪ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩

দিরাইয়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাত জেগে ধান কর্তন

amarsurma.com

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
হাওরে পানি প্রবেশের ভয়ে রাতের আঁধারে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে আধাপাকা ধান কাটছেন আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় কৃষকরা। এমন ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের তারাপাশা গ্রামে। গ্রামবাসি সূত্রে জানা যায়, গত ৭ এপ্রিল উপজেলার জারলিয়া বাঁধটি ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ও হাওরের কৃষকদের বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এখন পর্যন্ত হাওরের ধান শতভাগ কাটার উপযুক্ত হয়নি। তারপরও উজান থেকে আসা পানি হাওরে প্রবেশ করে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার ভয়েই কৃষকরা বাধ্য হয়ে রাতেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে ধান কাটছেন।
জানা যায়, দিরাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন ৩১নং পিআইসিটি জারলিয়া খেয়াঘাট সংলগ্ন। ০.৪৭১ কিলোমিটার এ বাঁধে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১৬ টাকা ৯২ পয়সা। গত ৬ এপ্রিল বাঁধটি ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, বাঁধে মাটি কাটার পর ভালো করে দুর্মুম ও ড্রেসিং না করায় বাঁধের মাটি সঠিকভাবে বসেনি। ফলে নিচ দিয়ে পানি ছুঁইয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩শত হেক্টর বোরো জমি তলিয়ে যায় বলে এলাকার কৃষকরা জানান।
এদিকে ভাটি এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম সহায় এক ফসলী ধান চাষ। অনেক পরিবারের পুরো বছরের খাওয়া-খরচ, সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ আনন্দ-বেদনার সাথি এই বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। ফলে তাদের দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত ফসল চোখের সামনে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগেই তাই বাধ্য হয়ে দিনের পাশাপাশি রাতেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে ধান কর্তন করছেন। তারাপাশা গ্রামের কৃষক সাইফুদ্দিন সুফিয়ান জানান, গ্রামের উত্তরের হাওরে আমাদের জমির পাশাপাশি রাতের বেলায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে অন্য কৃষকরাও ধান কেটেছেন। তিনি আরও জানান, এ সময় সৈয়দ ঈসমাইল, সৈয়দ সুলেমান, সাইফুল ইসলাম, রাহিম মিয়া, মাহফুজ আহমদ, জীবান আহমদ, ঈমন মিয়া, শাকিল মিয়া প্রমুখ কৃষকরা রাত জেগে ধান কেটেছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত দিরাইয়ের ছোট-বড় তিনটি হাওরে পানি প্রবেশ করে বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন হাওরেও আগাম বন্যার ভয়ে কপাল পুড়ছে কৃষকের, ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে কৃষকের স্বপ্ন এখন তলিয়ে গেছে পানির নিচে। হুড়ামন্দিরা, চাপতি, নলুয়ারপাড়ে এখন কান্নার রোল। এরই মধ্যে হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে পানির তোড়ে আরও ফাটল দেখা দিয়েছে। কৃষকের ঘুম নেই, নাওয়া-খাওয়া নেই। যেটুকু ফসল বাকি আছে তা বাঁচাতে রাতদিন খাঁটছে পুরো পরিবার। উপজেলার ঝিলকার, কালিয়াগুটা, বরাম, টাঙনি, উদগল, দাভাঙ্গা, বাদালিয়া, ছায়া, কাইছমা হাওরপাড়ে এখন শুধু ভয় আর আতঙ্ক।
বাঁধ ভেঙে ইতিমধ্যেই চাপতি, হুরামন্দিরা হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। কালিয়াগুটা, বরাম, টাঙনি, উদগল, দাভাঙ্গা, বাদালিয়া, ছায়া, কাইছমা হাওরসহ ছোট-বড় হাওরগুলোতে নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। চড়া সুদে আনা টাকা দিয়ে ফলানো ফসল ঘরে তুলতে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। শুধু দিনের বেলায়ই নয়, ফসল হারানোর ভয়ে অনেকে রাতেও ধান কাটছেন। দিরাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দিরাই উপজেলার ছোট-বড় ১০টি হাওর ও হাওর সংলগ্ন কয়েকটি হাওরে এ বছর ৩০ হাজার ১১০ হেক্টর বোরো চাষ হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে ইতিমধ্যে তলিয়ে ফসলহানি ঘটেছে চাপতি ও হুরামন্দিরা হাওরের। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, ওই দুই হাওর ৩ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। তবে কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষি বিভাগের দেয়া এ ক্ষয়ক্ষতির তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। গত রোববার রাতে দ্বিতীয় দফা ঢলের পানি বাঁধ রক্ষায় স্থানীয়দের প্রাণান্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে জগদল ইউনিয়নের সাতবিলা বেড়িবাঁধ ভেঙে হুরামন্দিরা হাওরে প্রবেশ করে। ১ হাজার ৫০ হেক্টর আবাদি জমি রাতের মধ্যেই পুরো তলিয়ে হাজারো কৃষকের সারা বছরের স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে যায়।
সূত্র আরও জানায়, এ বছর দিরাইয়ে মোট ৩০ হাজার ১১০ হেক্টর বোরো জমি আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে হাওরে ২৮ হাজার ৪৩০ হেক্টর ও হাওরের বাইরে (পতিত জমিতে) ১ হাজার ৬৮০ হেক্টর। হাইব্রিড মোট ১৩ হাজার ৮৭৭ হেক্টর, হাওরে ১২ হাজার ৫১২ হেক্টর ও হাওরের বাইরে ১ হাজার ৩৬৫ হেক্টর। উফসি মোট ১৫ হাজার ৯৮৮ হেক্টর, হাওরে ১৫ হাজার ৬৮৮ হেক্টর ও হাওরের বাইরে ৩শত হেক্টর। স্থানীয় মোট ২৪৫ হেক্টর, হাওরে ২শত হেক্টর ও হাওরের বাইরে ১৫ হেক্টর। চলতি বছর বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১০৩ মেট্রিক টন চাউল। গত বছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এ বছরের সমান থাকলেও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৪ মেট্রিক টন চাউল। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন চাউল। এ বছর বোরোতে ৩০টি প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নাহিদ আহমেদ জানান, আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত হাওরের ৫০ শতাংশ ধান কর্তন করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিরাই অফিসের উপ-সহকারি প্রকৌশলী শাখা কর্মকর্তা (এসও) এ.টি.এম. মোনায়েম হোসেন জানান, আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত বাঁধে বড় ধরণের কোন সমস্যা নেই। তবে সরালীতোপার বাঁধে কিছুটা ফাটল দেখা দেয়া ও কাজাউড়া গ্রামের উত্তরের পিআইসির বাইরে সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। আমরা এগুলো বন্ধ করতে কাজ করছি। তিনি আরও জানান, গতকাল পর্যন্ত পানি ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে ৫.৩৫ (এমএসএল) পয়েন্টে রয়েছে।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় নলুয়ার হাওরসহ ছোট বড় কয়েকটি হাওরের ছয়টি ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে কমপক্ষে আরও ১০ বেড়িবাঁধ। সূত্র জানায়, উপজেলার প্রধান হাওর নলুয়ার হাওরের বেতাউকা গ্রামের পাশে ১৪ নাম্বার প্রকল্প রোববার রাতে মাটি ধসে যাওয়া সোমবার সকাল থেকে বাঁধটি রক্ষায় কাজ চলছে। একইভাবে নলুয়ার হাওরের ডুমাইখালি এলাকার ৮ ও ৯ নাম্বার প্রকল্পের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধে রোববার রাতে ফাটল দেখা দিলে নলুয়ার হাওরে ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল হুমকিতে পড়ে। অপরদিকে রোববার রাতে সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের ঝিলকার হাওরের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিলে কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। পরে স্থানীয় মসজিদের মাইকে বেড়িবাঁধ রক্ষার আহ্বান জানালে আশেপাশের কয়েক গ্রামের গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ এসে বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেন। সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসান বলেন, ঝিলকার হাওরের বাঁধ ফাটলের খবর পেয়ে লোকজন নিয়ে সারারাত চেষ্টা করে বাঁধটি ঠিকিয়ে রাখা হয়। মঙ্গলবার ভোররাতে সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের তেঘরিয়ার হাওরের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ ফাটল দেখা দেয়। এলাকার লোকজন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জগন্নাথপুর পৌর এলাকা শাহপুর বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে কৃষকরা বাঁধটি রক্ষা করতে সোমবার থেকে কাজ করছেন। মিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক শেরিন জানান, মিরপুর ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ হাওর জামাইকাটা হাওরের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এলাকার লোকজনের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে বাঁধটি রক্ষা পায়। নলুয়ার হাওর বেষ্টিত চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জানান, নলুয়ার হাওরের কমপক্ষে ১০টি ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে নির্মিত ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধের কমপক্ষে ১০টি বাঁধ এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা সরেজমিনে বেড়িবাঁধগুলো ঘুরে দেখছি, নলুয়ার হাওরের ৫ থেকে ১৪ নাম্বার প্রকল্পের সবকটি বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, উপজেলার ছোট বড় ১৫ হাওরে এবার ২১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। তারমধ্যে এখনো ১০-১২ হেক্টর জমির ফসল হুমকিতে রয়েছে। তবে দ্রুত ধানকাটা চলছে বলে তিনি জানান। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম বলেন, ফাটল ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: