শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩

পালকি চড়ে শ্বশুর বাড়ি যায় না কেহ আর

নাজমুল ইসলাম মকবুল: আধুনিক এ পৃথিবীতে চলাচলের জন্য আবিস্কার হয়েছে অনেক বিস্ময়কর ও দ্রুতগামী যানবাহন। রাস্তাঘাট ও অবকাটামোগত উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে। সে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে পল্লী গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর তাই বেড়ে গেছে দ্রুতগামী সব যানবাহনের অসম্ভব জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা। কর্মব্যস্ত মানুষের ব্যস্থতা যেমন বেড়েছে তেমনি যে কোন কাজ স্বল্প সময়ে স্বল্প শ্রমে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ শেকড়ের সাথে মেশা অতীতের ঐতিহ্যবাহী অনেক জিনিসপত্রের ব্যবহার এবং রসম রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে শুধু বাধ্য হচ্ছেনা ভুলে যেতে বসেছে এসবের ব্যবহারও। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক সেকেলে মডেলের অতি জনপ্রিয় যানবাহনও এখন আর ব্যবহার করা হয়না। ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সময় বাচাতে অতীতের অনেক কিছুই পরিত্যাগ করতে হয়। তখন অতীত হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। অতীতকে জানা এবং পরবর্তী প্রজন্মকেও জানানোর প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। অতীতকে জেনে বা স্মরণ রেখে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে সুফল লাভ হয় সহজ। আমাদের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদি যাতে ভুলে না যাই এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে সে সম্পর্কে অন্তত জানতে পারেন সেজন্য ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেছি ‘‘চিরায়ত বাংলা’’। চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ হচ্ছে আমাদের অতীতের বহুল ব্যবহৃত নিত্য ব্যবহার্য এবং সমাজ সংস্কৃতির অংশ অধুনালুপ্ত যানবাহন ‘‘পালকি’’।
পালকি দেখতে প্রায় মাঝারি ধরণের সিন্ধুকের মতো। সাধারণত তৈরি করা হতো বাঁশ ও কাঠ দিয়ে এবং উপরে দেয়া হতো কাচা টিনের কারুকার্যময় মনোরম ও নিখুঁত ছাউনি। কাঠের কারুকার্যখচিত বাহারি ডিজাইন থাকতো পালকীতে। ভেতরে থাকতো বসার জন্য আসন এবং চতুর্দিকে কিছু ফাঁকা জায়গাও থাকতো যাতে আরামে বসার বা হেলান দেয়ার জন্য বাহকের উভয়পার্শ্বে ও পেছনে বালিশ দেয়া যায়। পালকির উপরাংশের সামন ও পেছন দিকে বড় লম্বা ও মজবুত বাঁশ সংযুক্ত করা থাকতো যাতে সহজে দুজন বা ওজন ও অবস্থাভেদে চারজন বেহারা মিলে একসাথে কাধে বহন করে চলতে পারেন। বর বহনের বেলায় পালকিকে বিভিন্ন বাহারি রঙের রঙিন পাতলা কাগজ সুন্দর করে কেটে তাতে আটা জাতীয় জিনিস দিয়ে লাগিয়ে সাজানো হতো, যাতে এক পলকে দৃষ্টি কেড়ে নেয় সবার। কিন্তু কনে বা মহিলাদেরকে বহন করার সময় পালকির খোলা অংশসহ চতুর্দিকে এমনভাবে পর্দা ঘেরা হতো যাতে ভেতরে কারো দৃষ্টি না পড়তে পারে কিংবা ভেতরের আরোহীনীকে যাতে কেহ দেখতে না পারেন। তখন অভিজাত এই পালকিটার নাম পরিবর্তন হয়ে নাম ধারন করে ‘‘সওয়ারী’’।
আগেকার যুগে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দূর্গম পথে জমিদার জোতদার বা মোড়লরা পালকি চড়ে যেতেন গন্তব্যে যা ছিল আভিজাত্য প্রদর্শণের অন্যতম একটি মাধ্যম। সালিশী বিচারের আসরেও বড় বড় বিচারকরা পালকি চড়ে হাজির হতেন বেশ আয়েশের সাথে। বড় বড় প্রবীন ও বয়োবৃদ্ধ মাওলানারা পালকি চড়ে ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করতেন আবার পীর মুর্শিদেরাও পালকীতে চড়ে যাতায়াত করতেন তাদের ভক্ত অনুরক্ত-মুরীদানদের বাড়ীতে বা মাহফিলে নিতান্ত জাকজমকের সাথে। পালকিতে গিলাফ লাগিয়ে সওয়ারীতে রূপান্তরিত করে মহিলারা যেতেন বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়িসহ অন্যান্য আত্মীয়দের বাড়িতে নাইয়র বা বেড়াতে। চলাচলের জন্য বৃদ্ধ বা অসুস্থ মহিলাদেরও একমাত্র আদর্শ বাহন ছিল পালকি। আগেকার যুগে রক্ষণশীল হিন্দু মহিলাদেরকে পালকিতে করে গঙ্গা স্নানেও নিয়ে যাওয়া হতো ঘটা করে।
পালকি বহনকারীদের বলা হয় বেহারা। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এদেরকে বলা হতো মালি। গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ছিল তাদের বসবাস। তবে তারা পূর্বপুরুষ থেকেই পালকি বহন বা বেহারার কাজকেই পেশা হিসেবে ধরে রাখতো এবং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। সাধারণত চার বেহারা বহন করতেন বোঝাই পালকি। তবে পালকিতে আরোহীর ওজন কম থাকলে দুজনও বহন করতে পারতেন। বেহারাদের হাতে থাকতো মাটিতে ভর দেবার বা কষ্ট লাগবের জন্য লাঠি। বোঝা বহনের সময় তাদের পরিশ্রান্ত শরির দিয়ে অঝর ধারায় ঘাম নির্গত হয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চলতে থাকতো তখন একেকজন বেহারাকে দেখতে মনে হতো জল্লাদের মতো। চলতে চলতে পরিশ্রান্ত হওয়ার পর তারা স্থান ভেদে পালকি মাটিতে রেখে জিরিয়ে নিত। তখন বিড়ি চুরুট বা পানি পান করে শরিরটাকে কিছুটা চাঙ্গা করতো।
আগেকার গ্রাম বাংলায় সোওয়ারী পালকি ছাড়া বিয়ের কথা কল্পনাই করা যেতনা। বেহারারা বরের বাড়িতে সকাল বেলায় পালকি নিয়ে আসার পর বিয়ে বাড়ির কিশোর-কিশোরিরা রকমারি পাতলা রঙিন কাটা কাগজে সাজাতো পালকিকে মনের মতো করে। উপরের চারি কোনে দিতো চারটি ঝাণ্ডা। কেহ বা বাহারি ডিজাইনের রঙিন বেলুন ফুলিয়ে পালকিতে বাধতো সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। বর যেতেন রকমারি সাজসজ্জায় সজ্জিত পালকি চড়ে মুখে রুমাল দিয়ে মুচকি মুচকি হেসে। গরম থেকে রেহাই পেতে পালকিতে দেওয়া হতো নিত্য নতুন ডিজাইনের বাহারি রঙের নতুন পাখা। বেহারারা কষ্ট লাগবের জন্য ধরতো বিভিন্ন ধরণের জারি গান। পালকির সামনে পিছনে বর যাত্রির দল হেটে হেটে চলতেন পথ। কনে বাড়িতে রকমারি খাবার লোভে পায়ে হাটার ক্লান্তি বরযাত্রিদের মধ্যে দেখা যেত না। ছেলে-বুড়ো সকলেই পালকির সাথে দ্রুত হেটে যেতে দেখা যেত। কোথাও কোথাও কনের বাড়ির নিকটবর্তী হলেই সকলকে আগমন সংবাদ দেবার জন্য ফুটানো হতো আতশবাজি। যাকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় গুল্লা ফুটানো। কনে বাড়িতে পৌছার পর গেইট অতিক্রম করতে শালা-শালীদেরকে দিতে হতো মুচলেকা বা হাদিয়া। অবশেষে প্যান্ডেলের পার্শ্বে যাবার পর কনে বাড়ির মুরব্বীয়ানদের অনুমতি নিয়ে পালকি থেকে নামতে হতো এবং বরের জন্য নির্ধারিত আসনেও অনুমতি নিয়ে বসতে হতো। বরপক্ষ অভিজাত হলে যাবার সময় কনের জন্য আলাদা পালকি (সওয়ারী) সাথে নেয়া হতো ফেরার পথে যাতে আরোহন করতেন নতুন কনে, আর টাকার জোর নিতান্ত কম হলে বরের সেই পালকীকেই সওয়ারীতে রূপান্তরিত করে তাতে তোলা হতো নতুন কনেকে। নতুন বর মনের সুখে হেটে হেটেই ফিরতেন বাড়ি। বাড়িতে এসেই বেহারাদের পাওনা চুকিয়ে দেয়া হতো সাথে দেয়া হতো বিভিন্ন ধরনের বকশিশ।
প্রাচীনকালে আভিজাত্যের প্রতিক ছিল পালকি। সাধারণত যে কেউ ইচ্ছে করলেই পালকিতে চড়তে পারতো না। আবার পালকিতে চড়ে জমিদার, ব্রাহ্মন, বা বড়লোকের বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে বা কারো ব্যক্তিগত রাস্তা দিয়ে যেতেও বিভিন্ন ধরণের বিধিনিষেধও ছিল। বিয়ে ছাড়াও অভিজাত মহলের যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত যান ছিল পালকি। পালকি চড়ে তারা গৌরব ও অহংকার করতো। প্রজা সাধারণ বা নিম্ন শ্রেণির কেহ ভয়ে পালকি চড়তে পারতো না, চড়লে জমিদার কর্তৃক শাস্তি পেতে হতো বা নিগৃহীত হতে হতো। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে আর কেহ পালকি চড়ে শশুর বাড়ি যায় না। রাজা-বাদশাহ, উজির-নাজির, আমির-উমরা, জমিদার-মোড়লরাও আর পালকি চড়েন না। পালকির স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ধরণের গাড়ি। বর্তমানে বিয়েতে বিভিন্ন ধরণের উন্নতমানের দামী কার, পাজেরো জিপ, লুচিতা, নোহাসহ আরও অনেক ধরণের যান; এমনকি ধনাঢ্য পরিবারের বিয়েতে হেলিকপ্টার পর্যন্ত দেখা যায়। এছাড়া হাতি কিংবা ঘোড়ার গাড়ি টমটমও কেহ কেহ ব্যবহার করেন শখের বশে। তাই বর্তমানে আর পালকির কদর নেই বললেই চলে। তবে যদ্দুর জানা যায় এখনও নাকি কোন কোন দূর্গম অঞ্চলে পালকির ছিটেফোটা ব্যবহার আছে।
পালকি আমাদের প্রাচিন ঐতিহ্যবাহী একটি বাহন। এ সম্পর্কিত অনেক প্রাচিন গান-পুথি, কবিতা-প্রবাদ প্রবচন ছিল্লখ ও কিংবদন্তি রয়েছে। প্রাচিন বিয়ের গান বা গীতেও পালকির কথা আছে। আমাদের অতিত ঐতিহ্য ও সমাজ সংস্কৃতির মাঝে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই পালকি।
সেই ঐতিহ্যবাহী পালকি এখন আমাদের মধ্য হতে বিদায় নিয়েছে যেন অনানুষ্ঠানিকভাবেই। বেহারারা পেটের তাগিদে জড়িয়ে পড়েছে অন্য পেশায়। আমাদের হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহি পালকি হয়তো দেখতে হবে যাদুঘরে গিয়ে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পালকি নামক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত বাহনকে হয়তো চিনবেই না। এ বাহনটিকে চিনাতে হলে তাদেরকে যাদুঘরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া হয়তো আর কোন উপায়ই বা থাকবেনা।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: