শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৫ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক, অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৬২৫-৬২৭৬৪৩
যেভাবে ইসলামের ছায়াতলে স্প্যানিশ নারী

যেভাবে ইসলামের ছায়াতলে স্প্যানিশ নারী

mariumআমার সুরমা ডটকম ডেক্সমারিয়ম, ২৯ বছর বয়সী স্প্যানিশ নারী। মাদ্রিদের শহরের ফুয়েনলাব্রাডার শ্রমিক-শ্রেণির এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই ১৯ বছর বয়স থেকেই। সেই সময়ে তার মরোক্কান বংশোদ্ভূত প্রেমিক তাকে একটি ধর্মীয় বই উপহার দেয়। আর এটিই তাকে ধীরে ধীরে ইসলামের পথে নিয়ে আসে। সেই দিনটির কথা স্মরণ করে মারিয়ম বলেন, ‘এটা কুরআন শরিফ ছিল না। এটি ছিল কেবলই ইসলাম সম্পর্কিত একটি বই। স্থানীয় একটি বই মেলায় এটি ছাড়ে বিক্রি হচ্ছিল। বইটি দেখে আমার কৌতূহল জাগে। তবে তাৎক্ষণিক এটার প্রতি আমার বিশ্বাস জন্মায়নি।’

হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রামান্যচিত্র ও তার জীবনী পড়ে তিনি ইসলামের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন এবং পরিশেষে কুরআনকে আয়ত্তে আনেন। তিনি বলেন,  ‘আমার শৈশব ও কৈশোরকাল ছিল খুবই সাদামাটা ধরনের। ১৭/১৮ বছর বয়স থেকেই আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন বাইরে সময় কাটিয়েছি।’ ইসলামের প্রতি তার জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার লাইফস্ট্যাইলেও আসতে থাকে পরিবর্তন। তিনি তার বাবা-মার কাছে কখনো কোনো কিছু গোপন করতেন না। কিন্তু তার জীবনে হঠাৎ কি ঘটতে যাচ্ছে- তিনি তার বাবা-মাকে বলতে পারেননি। বাবা-মাকে কী বলবেন? ভেবে অস্থির হয়ে যান তিনি। বিষয়টি যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবেই তিনি তার বাবা-মাকে বলতে চেয়েছেন, যাতে এ নিয়ে তার পরিবারে হঠাৎ কোনো ঝড় না বয়ে যায়।

একদিন মরিয়মের সেলফোনে আজানের জোড়ালো ধ্বনি বেজে ওঠলে তার বাবা-মা স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্তিতে পরে যায়। ‘আযান শুনে তারা আমাকে বলেন, এটি তাদের অন্তরকে একটু নাড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ আমার ইসলাম গ্রহণের কথা আগে কখনো তাদেরকে জানাইনি,’ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বলছিলেন মারিয়ম। একদিন তিনি তার বয়ফ্রেন্ডকে বাবা-মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার মাধ্যমে ইসলামের বাণীর ছোট ছোট ইঙ্গিতগুলো শ্রবণ করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন বই পড়তে থাকি। বাড়িতে অধিক সময় কাটানো এবং আগের মতো সুইমিং পুলে না যাওয়া-এসব পরিবর্তনগুলো বাব-মা বুঝতে পারেন।’

বাবা-মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মারিয়ম বলেন, ‘এতে বাবা-মায়ের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না কারণ আমরা একসঙ্গে বাস করছি এবং তারা বুঝতে পারে, এটা বরং আমার জন্য ভাল হয়েছে। কারণ আমি এখন আর ড্রিঙ্কস, স্মোক কিংবা মাদক সেবন করি না। তারা দেখতে পারেন যে, আমি ঠিক মতো কাজে যাচ্ছি ও ফিরে আসছি এবং একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করছি। কিন্তু এ নিয়ে আমি তাদের উপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চাই না কারণ এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়।’

মারিয়মের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি তার পরিবারের বাইরের লোকেদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এমন স্পর্শকাতর একটি বিষয় সমাজের মানুষ কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখায়। বাবা-মা’র সঙ্গে বাইরে বের হলে হিজাব পরতে হবে এবং সমাজের লোকজন আমাদের ঠিকই দেখবে। এটা আামাদের জন্য সহজ হবে না। একজন ধর্মান্তরিতকে দেখে মানুষ মনে করেন, তার (ধর্মান্তরিতের) বাবা-মা কি তাহলে ব্যর্থ হয়েছে? এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে আমি তাদের মুক্তি দিতে চাই। আমি তাদের কষ্ট দিতে চাই না।’ এ কারণে মারিয়ম তার গৃহীত বিশ্বাসের সঙ্গে তার নিজস্ব সংস্কৃতির মিশ্রনে জীবন পরিচালনা করতে থাকে। তার মধ্যে কোনো তাড়া নেই।  উদাহরণস্বরূপ, তিনি তার পরিবারের সঙ্গে বাইরে বের হলে মুখ ঢাকতেন না। মারিয়ম বলেন, ‘বাবা-মা আমার হিজাব এবং দীর্ঘ হাতাওয়ালা পোশাক দেখেছেন কিন্তু এসব পোশাক পরিহিত অবস্থায় তারা আমাকে দেখেননি। আমি জানি, আল্লাহ আমার ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন। এভাবে ইসলামি পোশাকে বের হলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে;  তাই ধীরে ধীরে এগুনোটাই ভাল মনে করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মা আমার খাবারে শুয়োরের মাংস দিত না। আমাদের বাড়ি রং করার সময় আমি আমার কুরআন হারিয়ে ফেলি। এটির সন্ধান করতে সবাই আমাকে সাহায্য করেছে। আমি খোলাখুলিভাবে তাদের বলিনি যে, আমি একজন মুসলিম। কিন্তু আমার এটি বলার প্রয়োজনও ছিল না। তবে আমি নিশ্চিত যে তারা আমাকে সন্দেহ করছে।’ গত তিন বছর ধরে মারিয়ম রমজান মাসে রোজা পালনের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে আসছে। কিন্তু এ বছরে তার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘আমি ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নেই, আমি রোজা না রেখে আর একটি রাতও পার করব না। আমার মনে হয়েছে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট জ্ঞান আমার হয়েছে। আমি অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেছি।’ তিনি সেদিনই তার নিকটতম বন্ধুদের এবং তার বয়ফ্রেইন্ডকে ফুয়েনলাব্রাডার আল সুন্নাহ ইসলামি কেন্দ্রের মসজিদে আসতে অনুরোধ করেন এবং সেখানে একজন ইমামকে সাক্ষী রেখে কালেমা শাহাদাৎ পাঠ করেন।

আমি খুব খারাপভাবে আরবির উচ্চারণ করতে থাকি।  আমি খুব নার্ভাস হয়ে যাই। আমি অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়ি। এতে আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। আমার ভেতর অন্যরকম শান্তি অনুভূত হতে থাকে। আপনি এটি একান্তে কিংবা আরো অনেক বেশি মানুষের সঙ্গেও করতে পারেন,’ মারিয়ম স্মিতস্বরে স্মরণ করছিলেন সেই দিনটির কথা। তিনি তার প্রেমিককে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে কিন্তু তিনি দুটি জিনিসকে আলাদা করার ওপর জোর দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি শতকরা ৯৯ শতাংশ মানুষ মনে করবে যে, আমি ভালোবাসার জন্য ধর্মান্তরিত হয়েছি।  আমি এ কাজটি করেছি কেবল একটা ছেলের জন্য। কিন্তু মানুষকে এটা বুঝাতে হবে যে, তাদের এই ধারণা ভুল। এটা বাধ্য করার জিনিস না। এটা আসে কেবলই অন্তর থেকে।’

মারিয়ম বলেন, বিষয়টি তাদের বিয়ের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেও, কিংবা বিয়ে না হলেও তিনি ইসলামের প্রতি অটল থাকবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজের জন্য ধর্মান্তরিত হয়েছি।  এটাই সত্য, আমার এই বিশ্বাস আমি একদিনে অর্জন করিনি। আমার বিশ্বাস, আমি ধীরে ধীরে অর্জন করেছি।’ মারিয়ম তার কণ্ঠস্বর নরম করে বলেন, ‘মানুষ যা ইচ্ছা মনে করুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তারা মনে করছে আমাকে ব্রেনওয়াশ করা হয়েছে কিংবা  আমি আমার ছেলে বন্ধুর জন্য এটা করছি। কিন্তু  আমি তাদের কোনোভাবে জাজ করতে যাচ্ছি না।’ গত আট বছর ধরে মারিয়ম একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করছে এবং হিজাব না পরেই তিনি সেখানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘যদিও সেখানে এ নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করার কেউ ছিল না কিন্তু হঠাৎ কেউ যদি আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইতো তখন তাদের ‘না’ শব্দটি বলতে পারতাম না।’

যতদূর সম্ভব তিনি তার সহকর্মীদের উদ্বিগ্ন রাখতে চাননি। তবে তিনি বলেন, ‘ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি তাদেরকে বলা সবচেয়ে সহজ ছিল কারণ তারা আমাকে মূল্যায়ন করল কি করল না এ নিয়ে আমি পরোয়া করি না। তারা আমাকে অনেক ভালবাসে যেমনটি আমিও তাদের বাসি।’ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের  মতো মারিয়মের বিশ্বাস স্প্যানিশ সমাজেও ইসলাম বিষয়ে মাত্রাধিক কুসংস্কার রয়েছে। সেখানেও ইসলাম নিয়ে সমাজের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। সত্যকে বিকৃত করার জন্য এবং নেতিবাচক বিষয়ে মনোযোগ দেয়ায় তিনি মিডিয়াকে দায়ী করেন। সিরিয়া বিষয়ে আলোচনায় কিংবা ব্রাসেলসে হামলা নিয়ে আলাপচারিতায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের কথা উল্লেখ করলে তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তিনি বলে, ‘সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা সত্য যে, কিছু মুসলিম দেশ রয়েছে যেখানে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার শাস্তি হয় না কিন্তু এটা ইসলামে অনুমোদিত নয়। এটা আসলে ধর্মের দোষ নয়। এর জন্য মূলত দায়ী মানুষ এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অভাব।’ মারিয়ম জানান, তার আগের জীবনের চেয়ে বর্তমানে একজন নারী হিসেবে নিজেকে অনেক বেশি মূল্যবান মনে করছেন। ‘ইসলাম উগ্র জাতীয়তাবাদী নয়। ইসলামের একটি সূরা সম্পূর্ণভাবে নারীর জন্য নিবেদিত। মায়ের পদ তলেই স্বর্গ।’ কুরআনকে আবৃত্তি করে তিনি বলেন। ধর্মান্তর মারিয়মের জীবনে স্বাধীনতার অনুভূতি নিয়ে এসেছে। তিনি জানান, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে সে অনেক বেশি সুখ এবং সন্তুষ্টি অনুভব করছেন। যেটিকে তিনি ‘অধিক ভারসাম্যপূর্ণ’ বলে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, ‘এখন বাইরে বের হলে আমি হিজাব পরিধান করি এবং এতে আমি নিজেকে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ অনুভব করি। এটা অদ্ভুত নয়? আমি যখন হিজাব পরি তখন আমি দেখতে পাই কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই এবং কেউ আমাকে বিরক্তও করছে না এবং এটাই হচ্ছে আমার স্বাধীনতা। নিজেকে হিজাবে আচ্ছাদিত করে ভেতরে আমি আমার ইচ্ছে মতো পোশাক পরতে পারি।’ স্বল্প বসনার মেয়েদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘তারা মনে করে স্বল্প পোশাক পরিধানে খারাপ কিছু নেই।  আমার শালীন পোশাক সম্পর্কেও আমার চিন্তা তাদের মতোই। এই পোশাকে আমি কাউকে আঘাত করছি না। এটা আমার জন্য ভাল।’ তিনি জানান, এখন তার কাজ হবে কুরআন অধ্যয়নের বিষয়টি অব্যাহত রাখা এবং তার পরিবারের ভয়কে উপশম করার প্রতি জোর দেয়া এবং সে আত্মবিশ্বাসী যে, তাদের ভয়কে তিনি যেকোনো মূল্যে দূর করতে পারবেন। তিনি স্মরণ করতে পারেননি কখন থেকে মারিয়া নামটি মারিয়মে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের জন্য নামটি উচ্চারণ করা সহজ এবং তারা আমাকে এ নামেই ডাকতে শুরু করে।’ মারিয়ম বলেন, ‘বাস্তব চ্যালেঞ্জ হবে আমার নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে আমার গৃহীত সংস্কৃতির একত্রিত শেখার কাজটি। উদাহরণস্বরূপ হিজাব।’ তিনি আরো বলেন, আমি মারিয়ম এবং একই সঙ্গে মারিয়াও।’ সূত্রস্পেনের এলপেইজ অবলম্বনে

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: