শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে: চৈত্রের আগাম বন্যার ভয়াবহতা ও নদী খননের প্রাকৃতিক প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করলেও নদী খননের পরিবর্তে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিরোধ করার কারণেই মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আক্রান্ত হয়ে সুনামগঞ্জের বোরো পানিতে তলিয়ে গিয়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
অপরদিকে ফি বছর বোরো ফসল রক্ষার বেড়িবাঁধ ও মেরামতের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসিরা সরকারের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি বরাদ্দ নিয়ে বাঁধের কাজ অসমাপ্ত রেখে ১৬’শ কোটির টাকার অধিক পরিমাণ ফসল ডুবিয়ে দিয়ে কৃত্রিম দুর্গত এলাকা বানিয়ে বাঁেধর টাকা লুটে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে কয়েকদিনের বৃষ্টির ও ওপারের নদী দিয়ে ধেয়ে আসা ঢলের পানির তোড়ে জেলার সব ক’টি বোরো ফসলী তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ফসলহারা কৃষকদের পক্ষ থেকে বোরো ফসল ডুবির কারিগর রুপী হাঙ্গরদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জোড়ালো হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা মানববন্ধন ও আন্দোলনে পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসিদের গ্রেফতারের জন্য একই দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে হাওর ডুবির কারিগরদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদকসহ সংশ্লিষ্টরা নীরব ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছেন বলে কৃষকরা অভিযোগ তুলেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের লালিত ঠিকাদার এবং পিআইসির লুটেরাদের গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য ফসলহারা কয়েক লাখ কৃষক পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
সরেজমিন নানা অনুসন্ধানে জানা গেছে, একদিকে বৃষ্টি ওপারের নদী দিয়ে ধেয়ে আসা ঢলের মুখে বেড়িবাঁধের কাজ অসমাপ্ত থাকায় জেলা ১১টি উপজেলায় প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর জমির আবাদকৃত বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফলে চৈত্র মাসেই এ জেলায় দেখা দিয়েছে কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য সংকট ও নানা আর্থিক টানাপোড়ন। ১৫০০ টাকার চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৫-২৮’শ টাকায়। দিন দিন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলছেন, সরকার যদি সেনাবাহিনী দিয়ে বাঁধের কাজ করাতেন, তাহলে হয়তো এমন ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হতোনা হাওর তীরের ২০ লাখ কৃষক পরিবারকে। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও হাওরের কাজ করেছে ঠিকাদার, পিআইসিসহ হাওরখেকো হাঙ্গরেরা। কাজ না করার পরও আগাম বিল দিয়ে বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পার্সেন্টিজ হাতিয়ে নেয় সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ পাউবোর ৩ জন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও ১০ জন সেকশন অফিসারসহ দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা। যাদের মধ্যে কৃষকদের প্রয়োজনের চাইতে নিজেদের দানবীয় চাহিদা পূরণই মুখ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার মোট ৪২টি হাওরে সুনামগঞ্জ পাউবোর আওতাভূক্ত বাঁধের আয়তন হচ্ছে ১৫০০ কিলোমিটার। এরমধ্যে হাওর এলাকার আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৭টি হাওরে মোট ৪৯৪ কিলোমিটার বাঁধের কাজ করার জন্য ঠিকাদারী প্রথায় ৪৬ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়। বরাদ্ধকৃত এ অর্থের ৫০% টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে আগাম প্রদান করেছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর, খাইহাওর, মাটিয়াইন হাওর, ঘোড়াডুবা হাওর, ছায়ার হাওর, নাইন্দা হাওর, দেখার হাওরগুলোতে সর্বাধিক ৯টি করে কার্যাদেশ পায় ফরিদপুরের গোয়াল চামহ্রদ এলাকার মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদ এবং ছায়ার হাওর, হালির হাওর, নাইন্দা হাওর, সাংহাইর হাওর, গুরমার হাওর, চন্দ্র সোনার তাল, ঘোড়াডুবা হাওরের কাজ ভাগিয়ে নেন সিলেটের বাগবাড়ী নিবাসী ঠিকাদার সজীব রঞ্জন দাস। শনির হাওর, মাটিয়াইন হাওর, ছায়ার হাওরের কাজে ৭টি পৃথক কার্যাদেশ পায় টাঙ্গাইলের আফজাল হোসেন মাহবুবের মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। ঘোড়াডুবা হাওর, কাইল্যানী হাওর, ভাণ্ডাবিল হাওরের কাজে ৪টি কার্যাদেশ পায় সুনামগঞ্জের আরপিননগরের ঠিকাদার শোয়েব আহমদের মেসার্স শোয়েব এন্টারপ্রাইজ। ৩টি করে পৃথক পৃথক কার্যাদেশ পায় সিলেটের দাড়িয়াপাড়া এলাকার চিন্ময় কান্তি দাসের নিম্মি এন্ড মুমু কন্সট্রাকশন, মেসার্স বোনাস ইন্টারন্যাশনাল, সুনামগঞ্জের হাজীপাড়ার খায়রুল হুদা চপলের মেসার্স নূর ট্রেডিং, নতুনপাড়ার বিপ্রেশ তালুকদার বাপ্পীর মেসার্স মালতি এন্টারপ্রাইজ, সুনামগঞ্জের স্টেশন রোডের শুভব্রত বসুর মেসার্স বসু নির্মাণ সংস্থা, ষোলঘরের কাজী নাসিম উদ্দিন লালা ও নতুনপাড়ার ঠিকাদার আতিকুর রহমান। ২টি করে পৃথক কার্যাদেশ পায় মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্স, সিলেটের হাউজিং এস্টেটের আব্দুল হান্নান ওরফে মুরগী হান্নানের মেসার্স হান্নান এন্টারপ্রাইজ, মৌলভীবাজারের মেসার্স আকবর আলী, সিলেটের ঠিকাদার জিল্লুর রহমানের মাহীন কন্সট্রাকশন, শেখ আশরাফ উদ্দিন, সুনামগঞ্জের নতুনপাড়ার মিলন কান্তি দের মেসার্স প্রীতি এন্টারপ্রাইজ, নুনা ট্রেডার্স, স্টেশন রোডের পার্থসারথী পূরকায়স্থর এলএন কন্সট্রাকশন, বড়পাড়ার ঠিকাদার রেনূ মিয়া, ঠিকাদার কামাল হোসেন। ১টি করে হাওরের কাজ পায় মেসার্স ইউনুস এন্ড ব্রাদার্স, টেকবো ইন্টারন্যাশনাল, নিয়াজ ট্রেডার্স, ম্যাম কন্সট্রাকশন, সৈকত কন্সট্রাকশন ও ঠিকাদার শামসুর রহমান বাবুলের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।
পাউবোর একাধিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকরা জানান, এসব নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটারদের হাতে হাওররক্ষা বাঁধের জন্য পর্যাপ্ত কোন লোকবল ছিলনা। ৫০% আগাম টাকা বিল হিসেবে উত্তোলন করে নিলেও যথাসময়ে বাঁধের কাজ তারা শুরু করেনি। তারা মনে করেছিল দায়সারাভাবে কোনরকমে কাজ করে নিলেই হলো। গতবার ফসল ডুবেছে বলে এবার আর ফসল ডুববেনা। এছাড়া নির্বাচিত হলেও কোন কোন ঠিকাদাররা নিজেরা কাজ না করে পার্সেন্টিজের বিনিময়ে ভাগীদারদের কাছে বাঁধের কাজ বিক্রি করে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। বাঁধের কাজে টেন্ডারে অংশ নেয়া বেশ ক’জন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যদি দলাদলির আশ্রয়ে শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালীদের, বহিরাগত ঠিকাদারদের হাতে কাজ তুলে দেয়া না হতো, তাহলে অন্য ঠিকাদাররা ঠিকমতোই বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করত। কিন্তু দরপত্রে অংশ নেয়ার পরও বেআইনীভাবে দলবাজীর আশ্রয়ে বৈধপন্থায় কাজ প্রাপ্তি থেকে কোন কোন ঠিকাদারকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অস্থানীয় ফরিদপুরের গোয়াল চামহ্রদ এলাকার মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদের নামীয় কাজ পরিচালনা করেন সুনামগঞ্জের নতুনপাড়া নিবাসী দীপ্ত তালুকদার টিটু। এই টিটু ঠিকাদার সজীব রঞ্জন দাসের শ্যালক ও তাহিরপুরের সাবেক চেয়ারম্যান দিনেশ রঞ্জন তালুকদারের ছেলে। তিনি ভগ্নিপতি ও মেসার্স খন্দকার শাহীন আহমেদের নামীয় কাজ করান বলে কৃষকরা জানান। সিলেটের দাড়িয়াপাড়া এলাকার চিন্ময় কান্তি দাসের নিম্মি এন্ড মুমু কন্সট্রাকশনের কাজ শহরের ষোলঘর আবাসিক এলাকার ঠিকাদার খালেদ হাসান, ঢাকার কবির আহমদের টেকবে ইন্টারন্যাশনাল ও আবুল হোসেনের বোনাস ইন্টারন্যাশনালের কাজ করান ষোলঘর আবাসিক এলাকার ঠিকাদার তছকীর উদ্দিন, সাতক্ষিরার শেখ আশরাফ উদ্দিনের ফার্মের নামীয় কাজ হাজীপাড়ার ঠিকাদার মফিজুর রহমান কুসুম, মেসার্স মাহিন কন্সট্রাকশন ও গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের কাজ দিরাইয়ের জগদল ইউনিয়নের কামরিবীচ গ্রামের ঠিকাদার জিল্লুর রহমান, নুনা ট্রেডার্স ও নিয়াজ ট্রেডার্সের কাজ জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রাম নিবাসী শহরের নতুনপাড়া এলাকার বর্তমান বাসিন্দা ঠিকাদার ভজন রায়, কুমিল্লার আব্দুল মান্নানের ম্যাম কন্সট্রাকশনের কাজ শহরের নতুনপাড়া সেন্টু তালুকদার ও আরপিননগরের সাজু, মৌলভীবাজারের মেসার্স আকবর আলীর নামীয় কাজ পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এর হানিফ, কুমিল্লার সৈকত কন্সট্রাকশনের কাজ তছকীর উদ্দিন, সিলেটের কামাল হোসেনের নামীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ পরিচালনা করেন কুরবাননগর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জিতেন চৌহান শাপলু শহরের ময়নার পয়েন্টের ঠিকাদার বশির আহমদ, হাছননগর নিবাসী তারেক আহমদ পরিচালনা করেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফসার উদ্দিনের বক্তব্য জানতে মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভাই এ নিয়ে আর দয়া করে রিপোর্ট লিখবেন না, এমনিতেই আমি চাপের মুখে আছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শেখ মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, পাউবোর বাঁধের কাজে অংশ নেয়া ঠিকাদার ও তাদের ভাগীদারদের নাম-তালিকা আমরা সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেবো, ইতিমধ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত রবিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটি ও দুর্যোগ সংক্রান্ত বিশেষ সভায় ঠিকাদার, ভাগিদার ও পিআইসি এবং পাউবো কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে ফসলহানীর জন্য দায়ী করা হয়েছে।
অপরদিকে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির হাওর ডুবির নেপথ্যের কারিগরদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়ের করতে সোমবার সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিকে জেলা সদরসহ ১১টি উপজেলা সদরে প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে হাওরের হাঙ্গরদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতারের জন্য একমাত্র বোরো ফসলহারা কৃষকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।