মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২০ পূর্বাহ্ন
ফারুক হোসাইন:
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাসহ সর্বত্রই বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। শহর কিংবা গ্রাম সব অঞ্চলের মানুষই যুক্ত হচ্ছে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশে। সরকারি-বেসরকারি সেবাতেও লাগছে এর ছোঁয়া। এজন্য বাংলাদেশও প্রযুক্তির একের পর এক প্রজন্মে প্রবেশ করছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়র পর এখন চলছে চতুর্থ প্রজন্মের (ফোরজি) ব্যবহার। প্রস্তুতি চলছে ফাইভজি’র। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির সেবা যাদের পাওয়ার কথা সেই গ্রাহকদের অবস্থা করুণ। সবচেয়ে ভালো নেটওয়ার্ক, দ্রুতগতির ইন্টারনেট, কম রেট, নিরবিচ্ছিন্ন সেবা নানা নামে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো চটকদার বিজ্ঞাপন দিলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন। টুজি’র যুগেও গ্রাহকরা যে ভয়েস কলের সেবা পেতেন ফোরজিতে এসে নেই সেই সেবাও। বরং প্রতিনিয়তই কলড্রপ, মিউটকলের শিকার হচ্ছেন তারা। আর ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ারও পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। নিম্ন মানের সেবা দিলেও টাকা আদায়ে ভুল হচ্ছে না তাদের। কলড্রপ, মিউট কল কিংবা টুজি গতির ইন্টারনেট দিয়ে গ্রাহকদের পকেট থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে পুরো টাকাই। বিষয়টি নিয়ে যাদের সরব থাকার কথা সেই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) নিরব ভূমিকায়। গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে তাদের যেনো কোন দায় নেই! গ্রাহকদের অভিযোগ এতো নিম্ন মানের সেবা দেয়ার পরও বিটিআরসি যখন কোন ব্যবস্থা নেয় না তখন বুঝতে হবে বিটিআরসিও মোবাইল ফোন অপারেটরদের ছাড় দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি যাদেরকে সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিয়েছে তাদেরকে ম্যানেজ করেই অপারেটররা দিনের পর দিন এই সেবা দিয়ে গ্রাহককে ঠকিয়ে যাচ্ছে।
কলড্রপ বিড়ম্বনার শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান চৌধুরী বলেন, মাঝে মাঝেই কথা বলার মাঝখানে হঠাৎ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক সময় আবার সংযোগ থাকলেও অন্যপাশ থেকে কোনো শব্দ পাই না। আমার কথাও অন্যজন শুনতে পায় না। তখন বাধ্য হয়ে আমাকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়। আবার অনেক সময় নিজ থেকেই কেটে যায়। কিন্তু মোবাইল ফোনের টাকা ঠিকই কেটে নেয়। অনেকবার গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি। তারা শুধু ‘দুঃখিত’ আর ‘দেখছি’ বলেই দায় সারেন। থ্রিজি ছেড়ে এখন ফোরজিতে আছি। কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যা যেন বাড়ছেই। এসব দেখার কি কেউ নেই?
আরেক শিক্ষার্থী রফিক হাওলাদার জানান, পড়াশুনার জন্য বিভিন্ন মেয়াদ ও পরিমাণের মোবাইল ফোনের ডেটা প্যাকেজ কেনেন। কিন্তু প্রায়ই তার কেনা ডেটার হিসাব-নিকাষ মেলাতে পারেন না। তিনি জানালেন, কিছুদিন আগে এক জিবির ইন্টারনেট প্যাক কিনি। কিছু সময় নেট ব্যবহারের পর মেসেজ এলো আমার আর ৪০০ এমবি বাকি আছে। আমি কিভাবে ৬০০ এমবি খরচ করলাম তা জানারও উপায় নেই। এভাবেই গ্রাহকের গলা কাটছে অপারেটররা।
সুলতানা নামে এক গ্রাহক বলেন, আমরা গত মাসে শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। জায়গাটা এমন দুর্গম কোথাও না, শহরের কাছেই। কিন্তু আমার দুটা অপারেটরের একটাতেও ইন্টারনেট কানেক্ট করতে পারিনি। অথচ দুটাতেই আমি ৭দিনের প্যাকেজ কিনে রেখেছিলাম। আমার পুরো টাকাটাই অপচয় হল। মোবাইল অপারেটরগুলো ফোরজি ইন্টারনেট দেয়ার দাবি করলেও সেটার সাথে পারফর্মেন্সের কোন মিল নেই।
বিটিআরসি’র ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. এহসানুল কবির জানান, অপারেটরদের মাসিক কলড্রপের পরিমাণ গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার কমিশনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে অভিযোগ করেন, মোবাইল ফোনের সেবার মান খুবই খারাপ। কল ড্রপ, কথা না শোনাসহ অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। গত বছরের মার্চ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ মাসে সাড়ে ৫ লাখের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে কমিশনে। এত বেশি অভিযোগ থেকে বোঝাই যাচ্ছে গ্রাহকরা সেবা পাচ্ছেন না।
একদিকে যেমন অপারেটরগুলো গ্রাহকদের পকেটের টাকা কাটছে, অন্যদিকে আবার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্বও ফাঁকি দিচ্ছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা এসব করের টাকা চাইতে গেলে সরকারকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। ২০১৯ সালের গ্রামীণফোনের কাছে অডিট আপত্তির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা দাবি করলে উল্টো টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আদালতের আশ্রয় নেয় এই দুই অপারেটর। মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে তাদের দেয়া অনাপত্তিপত্র বা এনওসি প্রদান বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হুমকি দেয়া হয় প্রশাসক বসানোর। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে গ্রামীনফোন ২ হাজার কোটি টাকা এবং রবিও আংশিক টাকা দিয়ে নিরব রয়েছে। বাকী টাকা কবে আদায় হবে সে বিষয়েও কোন অগ্রগতি নেই।
ডাক ও টেলিযোগাগোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, মোবাইলের সেবার মান যে নেমেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি যে অসহনীয় সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। দুটি বড় অপারেটর স্পেকট্রাম বা নেটওয়ার্ক স¤প্রসারণে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। তারা তাদের মুনাফা বাড়াচ্ছে অথচ তাদের যে পরিমাণ স্পেকট্রাম ও বিটিএস দরকার তা মোটেই নেই। যেহেতু অন্য দুটি অপারেটর বাজার দখল, নেটওয়ার্ক বা সেবার মানে বড় দুটির চাইতে শক্তিশালী নয়, সেহেতু আমরা যে কারণে এমএনপি নীতি করেছিলাম এবং মোবাইলের একটি একক মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম, তা তেমনভাবে কাজে লাগেনি। বরং সেটি বড় দুই অপারেটরের পক্ষেই গেছে। এসবের অন্যতম সমাধান হচ্ছে টেলিটকসহ দুর্বল অপারেটরদের সক্ষমতা বাড়ানো। আমরা টেলিটককে শক্তিশালী করার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি টেলিটক শক্তিশালী হলে মোবাইল বাজারের একচেটিয়া দাপট থাকবে না।
বিটিআরসির জরিপেই ওঠে এসেছে, ফোরজি সেবায় মানসম্মত যে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে তিন অপারেটর (গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক)। কোন অপারেটরেই গতিসীমা নেই বেঞ্চমার্কের ধারের কাছে। কল সেটআপেও ব্যর্থতার বৃত্তে তিনটি অপারেটর (গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও টেলিটক)। আর কলড্রপে বেঞ্চমার্কে নেই গ্রামীণফোন। বিটিআরসির সর্বশেষ ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস (কিউওএস) ড্রাইভ টেস্টের’ প্রতিবেদনে জানা যায়, কলড্রপে সর্বোচ্চ হার ২ শতাংশ, পরীক্ষায় অন্য তিন অপারেটর উত্তীর্ণ হলেও গ্রামীণফোন ব্যর্থ হয়েছে। গ্রামীণফোনের কলড্রপের হার ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যেকোন কল করার ক্ষেত্রে ৭ সেকেন্ডের মধ্যে সেই কল সংশ্লিষ্ট নম্বরে পৌঁছে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু রবি ছাড়া বাকি তিন অপারেটরই বেশি সময় নিচ্ছে। থ্রিজি ইন্টারনেটে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক বেঞ্চমার্ক স্পিড দিতে পারলেও ব্যর্থ হয়েছে টেলিটক। আর এই পরীক্ষায় টেলিটকের ফোরজি পরীক্ষা না হলেও অন্য তিন অপারেটরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোয়ালিটি অব সার্ভিসের বেঞ্চমার্ক অনুযায়ি, থ্রিজিতে ডাউনলোডের সর্বনিম্ন গতি ২ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড (এমবিপিএস) আর ফোরজিতে ডাউনলোডের সর্বনিম্ন গতি হওয়ার কথা ৭ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ডে (এমবিপিএস)। থ্রিজিতে টেলিটক ছাড়া অন্য তিন অপারেটরের গতি ৩ এমবিপিএসের ওপরে হলেও টেলিটকের গতি ১ দশমিক ৬৩ এমবিপিএস। অন্যদিকে ফোরজিতে কোন অপারেটরই নির্ধারিত এই মান পূরণ করতে পারেনি।
১৮ জেলায় বিটিআরসি পরিচালিত সর্বশেষ টেস্ট ড্রাইভে দেখা যায়- বরিশালে গ্রামীণফোনের স্পিড ৫ দশমিক ১ এমবিপিএস, রবির ৪ দশমিক ৮৯, বাংলালিংকের ৩ দশমিক ৫৬ এমবিপিএস। রংপুরে গ্রামীণফোনের ৬ দশমিক ৮৮ এমবিপি, রবির ৬ দশমিক ৫১, বাংলালিংকের ৪ দশমিক ৬৮ এমবিপিএস। রাজশাহীতে গ্রামীণফোনের ৬ দশমিক ৬৯ এমবিপিএস, রবির ৬ দশমিক ৭৫, বাংলালিংকের ৫ দশমিক ১ এমবিপিএস। খুলনায় গ্রামীণফোনের ৪ দশমিক ৬৩ এমবিপিএস, রবির ৫ দশমিক ৩৯ এবং বাংলালিংকের ৪ দশমিক ৯৬ এমবিপিএস।
মুঠোফোন গ্রাহকদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহীউদ্দিন আহমেদ বলেন, টেলিযোগাযোগ সেবার কোয়ালিটি অব সার্ভিস সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ অপারেটরদের গ্রাহক অনুপাতে তরঙ্গ কম থাকা। ফলে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা, কলড্রপ, ডাটা ব্যবহারে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি উদাসীনতা ও অনীহার কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে।
মহীউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিটিআরসির গঠন করা হয়েছে এই খাত, গ্রাহক ও দেশের স্বার্থ দেখার জন্য। কিন্তু সব সময় তারা খাত, সরকার ও নিজেদের স্বার্থ দেখেছে। গ্রাহক স্বার্থ সব সময় উপেক্ষিত থেকেছে। এর পেছনে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, গ্রাহকদের জন্য আইনে বলা আছে কোন গ্রাহক অভিযোগ করলে ৭ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্যত্থায় সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে তিন কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু এমন কোন নিদর্শন এখন পর্যন্ত বিটিআরসি দেখাতে পারেনি। যেখানে কমিশনই আইন মানে না সেখানে গ্রাহকরা সুবিধা পাবে কিভাবে? আর তারা গণমাধ্যমে যেসব অভিযোগ নিষ্পত্তির তথ্য তুলে ধরে তা ভ্রান্ত। দুই চারটা অভিযোগ নিষ্পত্তি করে কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। কমিশন অপারেটরদের প্রতি শতভাগ পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি বলেন, অক্টোবরে আমরা ১৩টি বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছি এখন পর্যন্ত সুরাহা পায়নি। তারা যে গ্রাহকের নয় বরং অপারেটরদের স্বার্থ দেখে এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার।
সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব