শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার: দেশের সড়ক পথ যেন এখন এক আতঙ্কের নাম, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে। সড়ক দুর্ঘটনার এ মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে? এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে; উত্তর বিহীন এমন প্রশ্ন মানুষের বিবেককে বোকা বানিয়ে তুলছে। প্রতিদিন সংবাদপত্র, টেলিভিশন আর অনলাইন পত্রিকাগুলোর পাতায় অন্য অনেক সংবাদের সাথে মিশে আছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। কিন্তু এর শেষ কোথায়, কীভাবে সম্ভব? এ নিয়ে টেকসই চিন্তার কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। দায়িত্বশীল সরকার তার দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার দাবী করলেও বাস্তবতা হচ্ছে পুরো উল্টো। আর তা না হলে দেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্র যন্ত্রের একটি মন্ত্রণালয়ের নাম ‘যোগাযোগ’ মন্ত্রণালয়। সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মতো ব্যক্তি থাকতে এ বিভাগ যদি ব্যর্থ হয়, তবে আর কোথাও সফলতার আশা করা যায়না।
সরকার দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন। অথচ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে যে একটি সহজলভ্য মানুষ নিয়ন্ত্রণ চলছে, তা সম্ভবত সরকার অনুমান করতে পারছেন না। বেশ কয়েক বছর আগে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রবাসি সংবাদিক আব্দুল গফফার চৌধুরীর জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি লেখা পাঠ করেছিলাম। সেখানে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর একটি যুক্তি দেখাত গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশে যে হারে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে করে সরকারের জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর চিন্ত করতে হবেনা। সড়ক দুর্ঘটনার কারণেই মানুষ এমনিতেই কমে আসবে।’ তার এই লেখাটি যে সময়োপযোগি যুক্তি, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা; বর্তমানে এটি অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অনেক কঠোর আইন করে যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা এর প্রতিকারে কোন কঠোর আইন হয়েছে বলে আমরা জানিনা। কিন্তু কেন তা হচ্ছেনা, কার স্বার্থে এই আইন সংসদে আসছেনা? দেশবাসির কাছে তা বোধগম্য নয়।
অনেক চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যে কোন দুর্ঘটনা বা গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলে এতে চালকের কোন দায় নেই! কী অবাক কাণ্ড! তাহলে কী তারা ‘চালক’ সেজে এ দেশের মানুষ হত্যার লাইসেন্স পেয়েছে? প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, হেলপার থেকে চালক, আনাড়ি চালকের সংখ্যাধিক্য; এসব নানা কারণে প্রতিদিন সড়কে লাশের মিছিল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিকারে ব্যর্থ সরকার ও প্রশাসন। যদি সড়ক দুর্ঘটনায় কঠোর আইন থাকতো, তবে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসতো। আবার গাড়ির মালিক শুধু অর্থের লোভে না পড়ে যদি মানবতাবোধের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতো, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়-সড়কে লাশের মিছিল বাড়তো না। যেমন-যে কোনভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটুক, এর দায়ভার অর্ধেক নিতে হবে চালক ও হেলপারকে। তখনই দেখা যেতো সড়ক দুর্ঘটনার কম-বৃদ্ধির হার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এ রকম আইন মালিকপক্ষ করে দেয়, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, সড়কে আর লাশের মিছিল বাড়বে না।
এদিকে ‘চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ নারী ও ৪৫ শিশুসহ মোট ২৯৮ জন নিহত ও ৮১০ জন আহত হয়েছেন। রাজধানীসহ সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক, জাতীয় সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে প্রাণঘাতী এসব দুর্ঘটনা ঘটে বলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দেশের ২০টি জাতীয় দৈনিক, আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থা এবং ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২ হাজার ৩৭৬ জন নিহত হয়েছেন। এ সময়ে ২ হাজার ১৭৯টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, যাতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে আরো ৬ হাজার ৩৪১ জন। এ নিয়ে চলতি বছরের ৯ মাসে ২ হাজার ৩৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ২ হাজার ৬৭৪ জনের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন ৭ হাজার ১৫১ জন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সেপ্টেম্বরে সংঘটিত দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ১৬ সেপ্টেম্বর, তাতে ২৩ জন মারা যায়। এছাড়া ১০ সেপ্টেম্বর ২২ জন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২১ জন, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৬ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৪ জন ও ৭ সেপ্টেম্বর ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। এনসিপিএসআরআর-এর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে দুর্ঘটনার জন্য প্রধান সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিংকালে নিয়ম ভঙ্গ, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্র“টিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এবং সড়কের বেহাল দশা।’
উপরিউক্ত তথ্য ছাড়াও দেশে অন্য অনেকভাবে প্রতিদিনই মানুষের প্রাণ ঝড়ছে। এসবের হিসেব কষলে কোন সুস্থ বিবেকবান ব্যক্তি স্থির থাকতে পারবেনা। যদি বলা হয় ‘মানুষ মানুষের জন্য’, তবে কেন এত প্রাণহানি? এর সঠিক উত্তর বা জবাব কোনদিন কী পাওয়া যাবে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক, সম্পাদক-আমার সুরমা ডটকম।