রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: দেশের চার মোবাইল ফোন অপারেটর কম্পানির কাছে বড় অঙ্কের কর পাওনা বাংলাদেশ সরকার। এ নিয়ে দীর্ঘ বিবাদে কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। গতকাল রবিবার এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ টেলিকমস কট আপ ইন ৫০০ ডলার মিলিয়ন ট্যাক্স রো’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্যবসায় থাকা চারটি সেলফোন অপারেটর কম্পানির কাছে চার হাজার কোটি টাকা (৫০ কোটি ডলার) কর বাবদ পায় সরকার। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এমন দাবি করা হলেও কম্পানিগুলো বলছে অনাদায়ী করের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা (পাঁচ কোটি ডলার) হবে। ফলে এ নিয়ে আইনি লড়াই কোনো সমাধান ছাড়াই চতুর্থ বছরে পা দিল। টেলিকম বাজারসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিবাদ টেলিকম শিল্পের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করছে। যেটি বর্তমানে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় একক উৎস। ২০১৫ সালে টেলিকম কম্পানিগুলো ১৪৩ কোটি ডলার কর বাবদ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে।
তবে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বলছে, কম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে যথাযথভাবে অবহিত না করে পুরনো সিম বিক্রি করে, এর মধ্য দিয়ে তারা নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তারা জুলাই ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত যেসব পুরনো সিম বিক্রি করেছে সেগুলোর বিপরীতে কর দেয়নি। তারা আরো অভিযোগ করে, বিষয়টিকে ঘোলাটে করার জন্য কম্পানিগুলো গ্রাহকদের তথ্যও গোপন করেছে।
চারটি কম্পানি হচ্ছে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি আজিয়াটা লিমিটেড এবং এয়ারটেল। চার কম্পানিই সরকারের কর দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বিষয়টি করসংশ্লিষ্ট বিচারালয়ে তুলেছে। মামলাটি যেহেতু আদালতের বিবেচনায় রয়েছে সেহেতু এ ব্যাপারে সরকার বা করসংশ্লিষ্ট কেউ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর প্রদান নিয়ে এ অচলবস্থার ফলে বিদেশি টেলিকম কম্পানিগুলো এখানে ব্যবসা করা নিয়ে হতাশ হচ্ছে, যা এ দেশে বিনিয়োগে অন্য বিদেশি কম্পানিগুলোকেও ভীত করতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ কোটি ৮০ লাখ মোবাইল ফোন গ্রাহকের বেশির ভাগই এ চার কম্পানির। এ নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল টি আই এম নুরুল কবির বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ টানছে টেলিকম খাত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের বিষয়টি দেখা উচিত। এ বিরোধের ফলে টেলিকম খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ কলম্বোভিত্তিক থিংকট্যাংক লার্নএশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, ‘টেলিকম কম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আস্থায় কিছুটা টান পড়েছে। ফলে এগুলো এখন গ্রাম পর্যায়ে নেটওয়ার্ক স্থাপনের ব্যাপারে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করছে।’ তিনি বলেন, ‘এশিয়ার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বোঝে না কিভাবে টেলিকম কম্পানিগুলোর কাছ থেকে সঠিকভাবে কর আদায় করতে হয়। ফলে এ নিয়ে দীর্ঘ সমস্যা তৈরি হয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এ বিভেদে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কিছুটা অস্পষ্টতা দেখা যায়। মূলত অপারেটরগুলো নিজেদের সুবিধায় সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।’ বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে ২০১২ সালে, যখন সরকার এ চারটি বিদেশি টেলিকম কম্পানির কাছে কর বাবদ ৫০ কোটি ডলার দাবি করে। এ অর্থ এসেছে কম্পানিগুলোর প্রতিটি সিম বিক্রি থেকে ১০০ টাকা করে ভ্যাট বাবদ। সরকার বলছে, পুরনো সিম বিক্রি অবৈধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কম্পানিগুলো ভ্যাট প্রদানের বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে। তবে কম্পানিগুলো পুরনো সিম বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করছে না। তারা বলছে, সরকার যে পরিমাণ কর পাওয়ার দাবি করছে তা সরকারের দাবীকৃত মোট অর্থের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। কর আপিল আদালতে বিষয়টি উত্থাপনের জন্য পাঁচ কোটি ডলার জমা রাখতে হয়। বাংলালিংকের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স প্রধান তৈমুর রহমান বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা।’
২০১২ সালে কর আদালত বিষয়টি রাজস্ব বিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেয় সমাধানের জন্য। কিন্তু এক বছরেও তার কোনো কিনারা হয়নি। সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ২০১৩ সালে টেলিকম অপারেটরগুলো বাংলাদেশের থ্রিজি তরঙ্গ নিলামে অংশ না নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। সেই সময় সরকার বিবাদ মীমাংসায় একটি প্যানেল গঠন করে দিয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পার হলেও তার কোনো কিনারা হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে টেলিকম অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মিত বৈঠক হলেও সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না। কোনো পক্ষই নমনীয় হচ্ছে না। ইতিমধ্যে আদালত থেকেও এর শুনানি স্থগিত হয়েছে এবং রাজস্ব বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে এর সমাধানের জন্য।
তৈমুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আমরা সব সময় খোলা মনে আছি এবং এর একটি সৌজন্যপূর্ণ সমাধান চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের বিবাদে সময় না দিয়ে আমাদের গ্রাহকদের আরো ভালো ও সুলভ সেবা দিতে চাই।’ কিন্তু উভয় পক্ষই এখন বলছে, বিষয়টি আবার আদালতে নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের সেক্রেটারি সরওয়ার আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে আদালত যদি আমাদের কোনো নির্দেশনা দেয় তবে আমরা তা মেনে নেব।’ এপি।