শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০১:৩০ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
সংবাদ শিরোনাম :

দিরাই-শাল্লায় চলছে বিলে লুটপাটের মহোৎসব: ১৫ বছরের ক্ষোভ বলছেন সাধারণ মানুষ

amarsurma.com
লুটপাটে জড়িত আওয়ামী লীগের লোকজনও: অভিযোগ মৎস্য জীবীদের

লুটপাটে জড়িত আওয়ামী লীগের লোকজনও: অভিযোগ মৎস্য জীবীদের

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষ ও জেলেরা নিজেদের খাবারের জন্যও যেখানে মাছ ধরতে পারেনি, দ্বিতীয় স্বাধীনতার অর্জনের পর এবার সে সকল বিলে চলছে লুটপাটের মহোৎসব। তবে এসব লুটপাটের পেছনেকোন ব্যক্তি বা সিন্ডিকেট কাজ করছে কি না, সে প্রশ্নের এখনও কোন কুল-কিনারা হয়নি। তবে কিছু ইজারাদার মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, লুটপাটে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী জড়িত। এলাকার সাধারণ মানুষ বলছেন, গত ১৫ বছরের ক্ষমতার অপব্যবহার, দেশে লুটপাট তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, এক দলীয় শাসন, নির্যাতন-নিপীড়নসহ সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের ক্ষোভ প্রকাশ করে বিল লুটপাট হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এ সপ্তাহে সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লায় প্রায় ১১টি জলমহাল লুট হয়েছে। এসব জলমহাল গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের দখলে ছিল। এ সকল জলমহালে সাধারণ মানুষ কোনভাবেই নিজে খাওয়ার জন্যও মাছ ধরতে পারতো না প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও মৎস্যজীবীদের কারণে। ৫ আগস্ট দেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর তাদের নিজেদের অপকর্মের কুফল ভোগ করার কথা আঁচ করতে পেরে কোন ধরণের লিখিত ছাড়াই দুই উপজেলার বিএনপি ঘরানার কিছু লোককে এসব জলমহাল রক্ষার স্বার্থে শরীক করেন। এরপরও গত এক সপ্তাহে সুনামগঞ্জের দুই উপজেলার ১১ বিলে লুটপাট হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার সকালে জেলার শাল্লা উপজেলার সতোয়া জলমহালে মাছ লুট করতে যায় হাজারও জনতা। ইজারাদারদের দাবি, এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কামান বিলে মাছ লুটপাটের মধ্য দিয়ে জলমহাল লুটের মহোৎসব শুরু হয় দিরাই-শাল্লা উপজেলায়। কাগজপত্রে এই বিলের ইজারাদার চরনারচর বিএম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির নামে ইজারা থাকলেও এই জলমহালের মালিক হিসেবে পরিচিত দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মোশারফ মিয়া ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয় কুমার বৈষ্ণব। সম্প্রতি কামান বিলের জলমহালের মাছ আহরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল ইজারাদার পক্ষ। এর মধ্যেই শুক্রবার ভোরে পাশের নোয়াগাঁও, কার্তিকপুর, মাইতি, হাসনাবাদ, শ্যামারচর, আটগাঁও, মির্জাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে জলমহালে মাছ ধরা শুরু করে। এভাবে গত এক সপ্তাহে একে একে উদীর হাওর (মুরগা নদী), সউত্বা, জয়পুর-আতনি, বেতইর নদী, লামা বেতইর, হালুয়া-ঘাটুয়া, দিরাই চাতল, কলকলিয়া, বড়গাঁও ইয়ারাবাদ গ্রুপ ও জোয়ারিয়া বিলে লুটপাট হয়।
চরনারচর বিএম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি সুধীর বিশ্বাস জানান, বছরে এ জলমহালে বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা রাজস্ব জমা দেন তারা। এবার নিয়ে ছয় বছর ধরে বিলের ইজারায় রয়েছে তাদের সমিতি। ইজারা নিতে অনেক টাকার প্রয়োজন, এজন্য ‘বছর-বছর চুক্তিতে’ আওয়ামী লীগ নেতা মোশারফ মিয়া ও জয় কুমার বৈষ্ণবকে শরিক রেখেছেন তারা। শুক্রবারের ঘটনায় বিল থেকে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
উদীর হাওরের ইজারাদার সুধীর রঞ্জন দাস বলেন, ১৮ বছর ধরে বিলের ইজারাদার তাদের সমিতি। এ বছর ৯০ লাখ টাকা ইজারামূল্য ছিল। ইতিমধ্যে এক কোটি টাকার মাছ তারা আহরণ করেছেন। লুট হয়েছে কমপক্ষে তিন কোটি টাকার মাছ। এই লুটপাটে কমপক্ষে ২০ গ্রামের মানুষ ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থককেও জলমহাল লুটপাটে অংশ নিতে দেখা গেছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের জলমহালে দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়ের পুঁজি রয়েছে।
জয়পুর-আতনি জলমহালের ইজারাদার জয়পুর আতনি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। চলতি বছর ভ্যাটসহ ৮৬ লাখ টাকায় জলমহাল ইজারা নেয় এই সমবায় সমিতি। গত কয়েক দিনে এখান থেকে ৫ কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে বলে দাবি করেন ইজারা সমিতির সভাপতি বিকাশ রঞ্জন দাস। জানা গেছে, এই বিলেও পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়।
শাল্লার আটগাঁওয়ের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রাহুল দাস জানালেন, তাদের এলাকার লুট হওয়া বিলের ইজারাদার সমিতির সঙ্গে অংশীদার ছিলেন দিরাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী, ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান কাজী।
বিভিন্ন জলমহাল লুটের ঘটনাকে বিগত সময়ে সরকার দলীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। দিরাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক দিরাই-শাল্লার সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীর ছোট ভাই মঈন উদ্দিন চৌধুরী মাসুক বলেন, গত ১৫ বছর যারা অত্যাচার-নির্যাতন, শাসন-শোষণ করে মানুষকে অতিষ্ঠ করেছিল, তাদের প্রতি মানুষ ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ নেতাদের জলমহাল লুটে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে সবাই।
সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা, বর্তমানে দিরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তাহির রায়হান চৌধুরী পাভেলের মতে, জলমহাল লুট শুরু করেছে অন্য উপজেলার লোকজন। পরে দিরাইয়ের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ উৎসবের মতো পলো বাওয়া শুরু করে। এমনও হয়েছে, ৫০০ টাকার মাছ ধরতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেছেন উৎসাহীরা। লুটপাটে বিএনপির কেউ জড়িত নয় দাবি করে তিনি বলেন, জলমহাল লুটের ঘটনায় দিরাই-শাল্লার মানুষের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। জলমহালের ইজারায় শরিক বিএনপির কেউ কেউ থাকতেই পারেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, টাকা থাকলে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা অপরাধের কিছু দেখছি না।
এদিকে দিরাইয়ে বিল লুটের ঘটনায় সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভার ভরারগাঁও গোফরাঘাট জলমহালে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে মাছ লুটের ঘটনার কচুয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি লংকেশ্বর দাস খোকার অভিযোগে ৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। দিরাই থানায় দণ্ডবিধি আইনের ১৪৩/৪৪৭/৩৭৯/৩৪ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় এজাহারনামীয় ২২ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও দুই হাজার ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, কচুয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ১৪২৮-১৪৩৩ বাংলা পর্যন্ত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জলমহালের ইজারা গ্রহণ করে এবং নিয়মিত খাজনা, ভ্যাট পরিশোধ করে মাছ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা চালিয়ে আসছিল। গত দুই বছর ধরে জলমহালটিকে মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে রাখা হয়েছিল।
বুধবার সকালে দিরাই থানার কল্যাণী গ্রামের জীবন রায় (৪৫), একই থানার চন্দ্রপুর গ্রামের এরশাদ মিয়া (৩২) ও হুমায়ূন (২০), বাউসী গ্রামের বাধন বৈষ্ণব (২২), সমরিন বৈষ্ণব (১৯) ও মৃদুল বৈষ্ণব (১৯), ভাঙ্গাডহর গ্রামের পন্টু তালুকদার (৩২) ও মৃদুল দাস (২৮), সরমঙ্গল গ্রামের আব্দুল তাহিদ (৪০), একই গ্রামের রমজান (৪০), রায়হান (৩৮), দবির মিয়া (৩৫), ছালিক মিয়া (৩৮), সম্রাট মিয়া (৫৫), সাজেদ মিয়া (২৭), হামিদ মিয়া (৪০), জিয়াবুর (৪০), ফরিদ মিয়া (৪৫), নাহিদ (২৭), মোহন মিয়া (৪০), কায়েছ মিয়া (২২) এবং ঘাগটিয়া গ্রামের রজত মিয়া (৩৫) এজাহারনামীয় এই ২২ জনসহ আরও প্রায় দুই হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তি জলমহালে প্রবেশ করে অবৈধভাবে মাছ ধরতে শুরু করে। জলমহালে থাকা আইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা, কার্পু, গ্রাস কার্পসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ অবৈধভাবে ধরে নিয়ে যায় তারা।
অন্যদিকে বিভিন্ন জলমহাল লুটের সময় স্থানীয় প্রশাসন সাধারণ জনতাকে বাধা প্রদান করলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ বাধা দিলে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে মাছ ধরতে আসা জনতা জলমহাল ইজারাদারদের দুইটি ছাউনি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
শাল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং স্থানীয়দের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপে জলমহাল এলাকা ছেড়ে যান মাছ ধরতে আসা কয়েক হাজার জনতা। পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। জলমহালের মাছ সুরক্ষায় পুলিশ সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকবে।
এদিকে সরকারি জলমহালে মাছ না ধরার পাশাপাশি এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এলাকাবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়াস চন্দ্র দাস।
আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, জেলার অন্যান্য বিল থেকে যারা অবৈধভাবে মাছ আহরণের চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, জলমহাল লুটপাটের ঘটনায় ইজারা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইজারাদাররা যদি মামলা করেন, আমরা আইনানুগভাবে শক্ত ব্যবস্থা নেব। যাতে এ ধরনের দুষ্কৃতিকারীরা ছাড় না পায়। লুটের আশঙ্কায় থাকা অন্য বিলগুলোর দিকে নজর রাখতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গ্রাম পুলিশকে বলা হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কেউ যাতে এ ধরনের ঘটনায় যুক্ত না হন এবং রাষ্ট্রের রাজস্বের ক্ষতি না করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com