বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন
সাইফ উল্লাহ, হাওরাঞ্চল প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের কড়ইগড়া গ্রামের বিশিষ্ট আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় শিক্ষাবিদ বিসেন্দ্র রিছিল (৬৩) আর নেই। মঙ্গলবার রাত সাড়ে তিনটায় নিজ বাড়িতে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে মারা গেছেন। বুধবার বিকেল চারটায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে পারিবারিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে সমাধিস্থ করা হয়। তাহিরপুরের বড়গোপ টিলা সংলগ্ন সুরাণী টিলায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সপরিবারে বসবাস করতেন বিসেন্দ্র রিছিল। সম্প্রতি তিনি তাহিরপুর উপজেলার শান্তিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে চাকুরি থেকে অবসর নেন। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন শোক জানিয়েছেন। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সুনামগঞ্জ জেলার শেষ সীমান্ত নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দার মধুকোড়া এলাকার আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধা বিসেন্দ্র রিছিল। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের এই যোদ্ধা ১৯৭৯ সনে বিয়ে করেন তাহিরপুরের কড়ইগড়া গ্রামে স্থায়ী হন। তিনি এলাকার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করতেন। একজন সৎ ও নিষ্টাবান শিক্ষক হিসেবে এলাকায় তার সুনাম রয়েছে। বিসেন্দ্র রিছিল গত বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ঘনঘন অসুস্থতায় ভোগতেন। পারিবারিকভাবে সাধ্যমতে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি কোন সহযোগিতা পাননি।
গতকাল বুধবার বিকেলে তার শেষ বিদায় যাত্রায় আদিবাসী সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেল চারটায় তাহিরপুর উপজেলা সমন্বয়কারী কর্মকর্তা মনোলাল রায় ও তাহিরপুর থানার এসআই জালালের নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসন মুক্তিযোদ্ধা বিসেন্দ্র রিছিলকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাজাই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মিয়া, আদিবাসী নেতা শংকর প্রমুখ। চোখের জলে প্রিয় মানুষকে বিদায় জানান স্বজন ও এলাকাবাসী।
১৯৭১ সনে নবম শ্রেণি পড়–য়া একহারা গড়নের আদিবাসী যুবক বিসেন্দ্র রিছিল এলাকার আদিবাসী বন্ধু সচিন হাজং, গজেন, মিনসন কুটি, এলবার্ট, ওয়ারকিং, সেভেন, অখিল, রনজিতসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শারীরিক গড়নে ছোট হওয়ায় ১১নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং তালিকায় নাম লেখাতে বেগ পেতে হয় বিসেন্দ্রকে। তবে অদম্য ইচ্ছের কারণে অক্টোবর মাসে সেই সুযোগ পান তিনি। আদিবাসী হওয়ায় সহযোদ্ধাদের অনেকেই ট্রেনিং ক্যাম্পে তার ভাষা বুঝতো না। ফলে ট্রেনিং নিতে গিয়ে নানা সমস্যা হয় তাঁর। মেঘালয়ের গারো হিলস এলাকায় ২১ দিন ট্রেনিং নিয়ে কোম্পানী কমান্ডার গোলাম আজম ও প্লাটুন কমান্ডার এনায়েতের অধিনে গেরিলা যুদ্ধে মাঠে নামেন তিনি। ছোটখাটো গড়নের ও শিশুর মতো সরলতার কারণে তাকে গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগান কোম্পানী কমান্ডার। বিসেন্দ্র বালকের বেশে ঘুরে ঘুরে রাজাকার ও পাক হায়েনাদের অবস্থানের তথ্য দিতেন। কলমাকান্দা থেকে নাজিরপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করতেন। রাতে অস্ত্র হাতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যোদ্ধার রেকি করতেন। কলমাকান্দা নাজিরপুর ও দাইয়া এলাকায় সম্মুখযুদ্ধেও জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেন তিনি। যুদ্ধরত অবস্থায়ই শরণার্থী শিবিরে তার মা ও বড় ভাবী মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে স্থানীয় রাজাকাররা তার বাড়িঘর লুটপাট করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
বিসেন্দ্র রিছিলের মৃত্যুতে তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল, সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর, আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমার, কালেরকণ্ঠ ও একাত্তর টেলিভিশনের সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি শামস শামীম শোক জানিয়েছেন। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারে প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।