রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৩ অপরাহ্ন
মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী: ইসলাম অপর ধর্মের অনুসারীদের সাথে প্রশস্ত মনে উদারতা প্রকাশের শিক্ষা দিয়েছে। বিশেষ করে যে অমুসলিম কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের অধিবাসী, তার জানমাল, ইজ্জত-আবরু ও অধিকার সংরক্ষণকে ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ বিষয়টির প্রতি পুরো খেয়াল রাখা হয়েছে যে, তারা শুধু তাদের ধর্ম পালনেই স্বাধীন নন, বরং জীবিকানির্বাহ, শিক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তারা সমান সুযোগ পাবেন। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের মনে আঘাত দেয়া থেকে সম্পূর্ণ নিবৃত্ত থাকতে হবে। আমাদের সম্মানিত ফকিহগণ এমনো লিখেছেন যে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ইহুদি বা অগ্নিপূজককে ‘হে কাফের’ বলে সম্বোধন করে, যার দ্বারা তার মনে আঘাত লাগে, তাহলে ওই সম্বোধনকারী ব্যক্তি গুনাহগার হবে (ফাতাওয়া আলমগীরী, খণ্ড ৫, পৃ. ৫৯)।
পবিত্র কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং দেশ থেকে তোমাদের বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)। এ আয়াতের ভিত্তিতে হাদিসের ভাণ্ডার, ইসলামি ফিক্হ ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলি অমুসলিম নাগরিকদের সাথে শুধু উদারতা নয়, বরং উত্তম আচরণ ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদানের ওপর গুরুত্ব ও প্রেরণায় ভরে রয়েছে। আমার ‘ইসলাম আরো সিয়াসি নাযরিয়্যাত’ (ইসলাম ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা) গ্রন্থে এ শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
তবে উদারতা, উত্তম আচরণ ও ইনসাফের অর্থ কখনো এটা নয় যে, ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের মাঝে পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য মিটিয়ে দিতে হবে এবং মুসলমানেরা উদারতার উচ্ছ্বাসে অমুসলিমদের বিশ্বাস ও ধর্মকে সমর্থন দিতে শুরু করবে। অথবা ওই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে শরিক হয়ে বা তাদের ধর্মীয় নিদর্শনাবলি-ঐতিহ্যকে আপন করে নিয়ে তাদের ধর্মের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবে। পবিত্র কুরআন শরিফ এ ব্যাপারে যে স্পষ্ট কর্মপন্থা বর্ণনা করেছে, তা হচ্ছে- ‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমার জন্য আমার ধর্ম’ (সূরা কাফিরুন, আয়াত : ৬)।
ইসলামি রাষ্ট্রে সভ্যতা ও শিষ্টাচারের বৃত্তের মধ্যে থেকে নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব পালন করার পূর্ণ অধিকার অমুসলিমদের রয়েছে। আর সরকারের দায়িত্ব হলো, তারা নিজেরা এতে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না, অন্য কাউকে করতেও দেবে না। তবে এর অর্থ এটা নয় যে, তাদের ওই ধর্মীয় উৎসব ও পার্বণ যা তাদের বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেখানে কোনো মুসলমান তাদের সম্প্রদায়ের একজন সদস্যের মতোই অংশ নেবে। হিন্দুদের গত দিওয়ালির সময় আমাদের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা উদারতার উচ্ছ্বাসে দিওয়ালি উৎসবে অংশ নিয়েছেন। কিছু নেতা তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে তিলক পর্যন্ত লাগিয়েছেন। তাদের ‘মানসিক প্রশস্ততা’র বিষয়ে গৌরবদীপ্ত ঢঙে বেশ ফলাও করে খবর প্রকাশ করা হয়েছে। খোদ আমাদের (পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী দিওয়ালির অনুষ্ঠানে শুধু অংশই নেননি, কেকও কেটেছেন।
পত্রিকার তথ্য মোতাবেক, তিনি এই আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছেন যে, তাকে যেন হোলির উৎসবে ডাকা হয় এবং তার ওপর রঙও ছিটানো হয়। সম্ভবত তার মাথায় এই একপেশে বিষয়টা কাজ করেছে যে, ভারতে মুসলমানদের সাথে যে অসহনীয় আচরণ প্রকাশ করা হচ্ছে, তার বিপরীতে পাকিস্তানের এমন উদারনীতি প্রকাশ করা হোক যে, পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের আনন্দে কতটা সমান অংশীদার।
কিন্তু এ বিষয়টি তার দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে যে, দিওয়ালির সাথে অনেক বিশ্বাস ও কল্পনার সম্পর্ক রয়েছে, যেগুলোর ভিত্তি দেব-দেবীর, তথা শিরকজাত বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেই দিকেও তার দৃষ্টি যায়নি যে, দেওয়ালিতে অংশ নিয়ে কেক কাটার তাৎপর্য কী? এর প্রেক্ষাপট কী? জগতের স্বাভাবিক নিয়ম হলো, সাধারণত কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেক কাটার প্রথা পালন করা হয়। প্রশ্ন জাগে, দিওয়ালির অনুষ্ঠানে কার জন্মদিন পালন করা হয়? বহু হিন্দুর বিশ্বাস মতে, ‘ধনসম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী’ লক্ষ্মী দিওয়ালির প্রথম দিন জন্মগ্রহণ করেন। আর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দেবতা ধন্বন্তরির জন্মদিনও নাকি এটাই (উইকিপিডিয়া)। সুতরাং লক্ষ্মীর মূর্তির পূজা দিওয়ালি উৎসবেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাদের এই বিশ্বাস আছে, তারা কেক কাটবেন বা প্রদীপ জ্বালাবেন, এটা তাদের ধর্মীয় নির্দেশ। কিন্তু যে মুসলমান একত্ববাদে বিশ্বাস রাখে এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই)-এর ওপর ঈমান তার পরিচিতির আবশ্যিক অংশ, তার জন্য এসব বিশ্বাসের বাইরের কর্মকাণ্ডে অংশীদার হওয়ার নাম উদারতা নয়; বরং তা তোষামোদি, মনোরঞ্জন এবং নিজের বিশ্বাসের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য সব বক্তব্য ও ক্রিয়াকলাপ তার ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পুরো জাতির প্রতি সম্বন্ধযুক্ত। এ জন্য এ ব্যাপারে সব দিক বিবেচনা করা, সব দিকে খেয়াল রাখা ও ভিন্ন ভিন্ন দিকগুলোর মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা খুব জরুরি।
দেশের অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি উদারতা ও সদাচরণ প্রকাশ করা এবং তাদের মর্যাদা ও আরামদায়ক জীবনযাত্রার প্রতি খেয়াল রাখা অবশ্যই জরুরি এবং প্রশংসার্হ। আবার প্রতিটি জিনিসের একটি সীমা আছে। তা অতিক্রম করা দ্বারাই চরমপন্থার রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। অমুসলিম বা তাদের উপাসনালয়ের ওপর হামলা অথবা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে বাধাদান নিঃসন্দেহে গুনাহ ও নিন্দার যোগ্য গর্হিত কাজ। অপর দিকে তাদের বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও পার্বণে কোনো মুসলমানের শরিক হওয়াও নাজায়েজ ও নিন্দনীয়। মধ্যমপন্থা বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির মাঝখান দিয়েই অতিবাহিত হয়ে থাকে।
পাকিস্তানের দৈনিক জং ১৯ নভেম্বর, ২০১৫; উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক স্কলার