রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৪ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম :
সংবিধানে বর্ণিত ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’ করার দায়িত্ব পালনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপের মত একটি গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে, যে কারণে অনেক নারী ভবিষ্যতে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন বলে মন্তব্য করেছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে ‘সুজনসুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে ‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জেন্ডার গ্যাপ ও আরও কিছু প্রশ্ন’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব নাসিম ফেরদৌস এবং নারীনেত্রী ও অর্থনীতিবিদ জনাব সালমা খান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আজ, ২৫ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ। ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদ কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এ প্রসঙ্গে, বিশেষত অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। ২০০৮ সালে প্রণীত ভোটার তালিকাটি ছিলো আমাদের জন্য এক বড় গর্ব এবং পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকায় দেখা দেয় নানা অসঙ্গতি। ওঠে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ। বিশেষ করে জানুয়ারি ২০১৫-এ প্রকাশিত ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ একটি বড় অসঙ্গতি হিসেবে দেখা দেয়।’
তিনি বলেন, ‘২০০৮-এর তালিকা অনুযায়ী আমাদের ভোটার সংখ্যা ছিলো মোট আট কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮। ওই তালিকা অনুযায়ী নারী ভোটার ছিলো পুরুষ ভোটার থেকে ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ বেশি এবং ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের বিভাজন বা ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ ছিলো +১.৭৪%। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে হালনাগাদ করার পর ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় নয় কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৩১। নারী ভোটার ছিলো পুরুষ ভোটার থেকে দুই লাখ ৯১ হাজার ৩৯৯ কম এবং জেন্ডার-গ্যাপ -০.৩২%। কমিশন ২০১৪ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পরবর্তী উদ্যোগ নেয় এবং ২ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে একটি খসড়া সাপ্লিমেন্টারি তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকা অনুযায়ী, নতুন ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লাখের কিছু বেশি এবং নতুন ভোটারদের মধ্যে জেন্ডার গ্যাপ -১১.৬৭%। তবে চূড়ান্ত তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ-১২%। কী কারণে এ জেন্ডার গ্যাপ হলো, যার ফলে নারীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই ব্যাখ্যা দাবি করার অধিকার জনগণের রয়েছে এবং কমিশন তা প্রদান করবে বলে আমরা আশা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে পুরুষ-নারীর অনুপাত বা সেক্স রেশিও ১০০.৩। এ হিসেব অনুযায়ী, নারীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় কাছাকাছি। তাই ভোটার তালিকায় নতুন ভোটারদের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে যে -১২% জেন্ডার গ্যাপ দেখা যায় তার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।’ এছাড়া তিনি কিছু আইনগত বিষয় যেমন, সর্বশেষ হালনাগাদ কার্যক্রমে বাড়ি বাড়ি না গিয়েই ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার অভিযোগ, আজ থেকে শুরু হওয়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে ১৫-১৭ বছর বয়স্কদেরও নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা, জানুয়ারির পরিবর্তে জুলাই মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদের ফলে আইনের লঙ্ঘন এবং হালনাগাদ কার্যক্রমের পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা না চালানোর অভিযোগ আনেন।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে অর্পিত ‘ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’ করার দায়িত্ব পালনে বর্তমান কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপের মত একটি গুরুতর, কিন্তু অনাবশ্যক, সমস্যা দেখা দিয়েছে। আজ শুরু হওয়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রমটি অব্যাহত থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমরা কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে আমরা হালনাগাদ সম্পন্ন হবার পর তৃতীয় পক্ষ দ্বারা পুরো তালিকাটি অডিটের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাই।’
সভাপতির বক্তব্যে জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা নাগরিকরা একটি সঠিক ভোটার তালিকা চাই, যেখানে জেন্ডার গ্যাপের মত সমস্যা থাকবে না। যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে সুষ্ঠুভাবে হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হবে বলে আমরা আশা করি।’
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘১৫-১৭ বছর বয়স্কদের কী উদ্দেশ্যে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে তা কমিশনের স্পষ্ট করা উচিত। ভোটার তালিকায় যেসব জেলায় জেন্ডার গ্যাপ বেশি রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা তথা ব্যাপক অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে, যাতে জেন্ডার গ্যাপ কমে আসে।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘নতুন ভোটারদের মধ্যে বিরাট পরিমাণের জেন্ডার গ্যাপ প্রমাণ করে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।’ বর্তমান কমিশন গোঁজামিলের কমিশনে পরিণত হয়েছে, তাই এ কমিশনের অধীনে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। ভোটার তালিকার একটি সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি জানান তিনি।
সংবিধানের ১১৯ নং অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম একটি কাজ। হালনাগাদ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে কমিশন অতীতের বিভিন্ন অভিযোগ কাটিয়ে উঠবে বলে আমরা আশা করি।’
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে যেখানে নারীদের আয়ুস্কাল পুরুষের তুলনায় বেশি, সেখানে ভোটার তালিকায় নারীর সংখ্যা কমে হবে কেন? এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে সালমা খান বলেন, ‘ভোটার তালিকায় এ জেন্ডার গ্যাপ কেনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের সাড়ে ৫ কোটি নারী নিজ গৃহে অথনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত। তাই বাড়ি বাড়ি না গিয়েই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা ছাড়া জেন্ডার গ্যাগের আর কী কারণ থাকতে পারে? ’ এর প্রভাব ভবিষ্যতে আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নাসিম ফেরদৌস বলেন, ‘বর্তমান সরকার যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছে সেখানে ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।’ ভবিষ্যতে নারীদের ভোটার করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন।