শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ: টানা দশ দিন ভাইরাস জ¦রের সাথে লড়াই করে এক নারী কবিরাজের খপ্পরে পড়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে সুনামগঞ্জের বিশ^ম্ভরপুরে বৃহস্পতিবার না ফেরার দেশে অকালেই চলে যেতে হল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়–য়া উপজেলার জনপ্রিয় বাউল শিশুশিল্পী সখিনা খাতুনকে (৯)। সখিনা বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের রতারগাঁওয়ের দক্ষিণপাড়ার হতদরিদ্র কুদ্দুছ মিয়ার শিশু কন্যা ও রতারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ঘটনার পর গ্রাম্য নারী কবিরাজ শুক্রবার ভোরে গ্রাম ছেড়ে গাঁ ঢাকা দিয়ে রাজধানী ঢাকায় চলে গেছেন নির্বিঘেœ।
জানা গেছে, উপজেলার রতারগাঁও কুদ্দুছ মিয়ার শিশু কন্যা সখিনার গত ২৭ জুন মঙ্গলবার থেকে পুর্বে গাঁয়ে জ¦র উঠে। জ¦রে সখিনা কাবু হয়ে ঘুমের ঘোরে অস্থির হয়ে প্রলাপ করতো। পরিবারের লোকজন স্থানীয় চিকিৎসকের সহায়তায় প্রাথমিক চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি তাকে গ্রাম্য মহিলা কবিরাজের নিকট নিয়ে গেলে জি¦ন-ভূতে ধরেছে এমন অন্ধ বিশ^াসের ঘোরে পরিবারের লোকজনকে ফেলে সখিনকে ঝাঁড়-ফুঁক, তৈল-পানি পড়া ও তাবিজ দেয়া হয় আরোগ্য লাভের জন্য।
এদিকে ঝাঁড়-ফুঁক, তৈল, পানি পড়া ও তাবিজ কবজের ভরসায় ক্রমশ ভাইরাস জ¦রের নিকট টানা দশ দিন কাবু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা সখিনার শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে ৬ জুন বৃহস্পতিবার দুপুরে অকালেই তার মৃত্যু ঘটে। আইনি ঝামেলা এড়াতে কবিরাজ ও তার অনুগত প্রভাবশালীদের পরামর্শে পরিবার-স্বজন গ্রামবাসিরা রাতেই নামাজে জানাজা শেষে গ্রামের পাশর্^বর্তী বাঘবের বাজারের পাশের্^ থাকা কবরস্থানে সখিনাকে দাফন করা হয়েছে।
অন্যদিকে সখিনার অকাল মৃত্যুর খবর বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েলে বিদ্যালয়ের সহপাঠি, শিক্ষক, সুশীল সমাজ ও উপজেলার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসার পাশাপাশি কথিত কবিরাজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে গ্রেফতার করার জন্যও কেউ কেউ আহবান জানিয়েছেন আইন-শৃংখলা বাহিনীর প্রতি।
উপজেলার রতারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন কুমার দে বলেন, সখিনা খুব ভাল করে বাউলশাহ আবদুল করিমের গান ও পল্লীগীতিসহ অসংখ্য গান গাইত। সে উপজেলা পর্যায়ে আন্ত:প্রাথমিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক (ম্যাডাম) সখিনাকে দেখতে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে। ফিরে এসে শিক্ষকরা জানান, সখিনা গত ১০ দিন ধরে জ¦রে ভুগে কোন কিছুই আহার করেনি, শুকিয়ে গেছে তার শরীর, পবিারের লোকজন জানিয়েছে কবিরাজ নাকি বলেছে সখিনাকে জি¦ন-ভূতে ধরে চর থাপ্পর মেরেছে। এ অবস্থায় বিদ্যালয় ছুটির পর আমরা সকল শিক্ষক ফের সখিনার বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নেই তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণের জন্য। কিন্তু বিদ্যালয় চলাকালীন সময়েই দুপুরে খবর আসে সখিনা মারা গেছে। তিনি আক্ষেপ ও ক্ষেভ প্রকাশ করে আরো বলেন, এ শিশু শিল্পীকে কবিরাজের ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করতে হল, অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা অভিজ্ঞ কোন চিকিৎসকের নিকট নিয়ে গেলে সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা পেলে হয়ত সখিনাকে এভাবে মরতে হতোনা, তাকে বাঁচানো যেত।
উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল হাসিম শুক্রবার বলেন, আমি স্থানীয় বাঘাবের বাজারে বিকেলে বসাছিলাম, ওই সময় আবদুল কুদ্দুছের শিশু কন্যা সখিনার লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যেতে দেখে লোকমুখে জানতে পেরেছি সখিনার জ¦র হয়েছিলো, কিন্তু কবিরাজের ভুল চিকিৎসায় ভুল পরামর্শে তার শিশু কন্যা অকালে মারা গেছেন।
উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রওশন আলী শুক্রবার বললেন, এ ঘটনা আমি এখনও কারো নিকট থেকেই শুনিনি বা কেউ আমাকে জানায় নি।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অনুকুল দাস শুক্রবার বলেন, আমি বৃহস্পতিবার রতারগাঁও বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, সখিনার মৃত্যুর খবর বিদ্যালয়ে পৌছার পর আমিসহ শিক্ষক ও সখিনার সহপাঠিরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তিনি আরো বলেন, সখিনার মতো আর যেন কোন শিশু কিংবা লোকজন কবিরাজের ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে না হয়, সে জন্য প্রয়োজন ভণ্ড কবিরাজের বিরুদ্ধে আইন-শৃংখলা বাহিনী স্বপ্রণোদিত হয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়া।
নিহত শিশু শিল্পী সখিনার পিতা রতারগাঁও বাসিন্দা ও স্থানীয় বাঘবের বাজারের হত দরিদ্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী কুদ্দুছ মিয়ার সাথে শুক্রবার যোগোযোগ করা হলে তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে জানান, আমার কলিজার টুকরা সখিনার প্রথম জ্বর হয়েছিলো, সে মতে বাঘাবের বাজারের চিকিৎসক আশরাফ আলীর মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ হলে আমাদের রতারগাঁও গ্রামের ইছব আলীর স্ত্রী গ্রাম্য মহিলা করিাজের কাছে নিয়ে গেলে উনি সখিনাকে দেখে বলেছেন সখিনার ওপর জি¦ন-ভূতের আছর পড়েছে, জি¦ন-ভূত সখিনাকে চর থাপ্পর মারছে, ডাক্তারি চিকিৎসায় সখিনায় ভালো হবেনা তার ভালো (সুস্থ) হওয়ার জন্য ওই মহিলা কবিরাজ পানি, তৈল পড়া, ঝাঁড়-ফুঁক ও তাবিজ দিয়েছে বিনিময়ে টাকা পয়সাও নিয়েছে। কিন্তু কবিরাজের কথায় বিশ^াস করাটাই আমার মেয়ের জন্য কাল হয়ে দাড়াল, আমার মেয়েকে অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করতে হল।
মহিলা কবিরাজ এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে কুদ্দুছ মিয়া বলেন, শুক্রবার সকালেই ওই মহিলা কবিরাজ বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে।
বিশ^ম্ভরপুর থানার ওসি মোল্লা মোঃ মনির হোসেনের বক্তব্য জানতে শুক্রবার সন্ধ্যায় যোগোযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকে বললেন, এ ব্যাপারে এখনো আমি কিছুই জানিনা, আমার কাছে এ ব্যাপারে কোন তথ্যও নেই, আর কেউ অভিযোগও করেন নি।