শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক:
তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাদের সরকারকে বিরক্ত ও ‘অস্থিতিশীল’ না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর শনিবার দোহায় প্রথম মুখোমুখি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে তালেবান। এদিকে, আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশগুলোর সরকারকে হাজার কোটি ডলার হস্তান্তর করার জন্য জোর দিচ্ছে তালেবান। এই দাবি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করে তালেবানরা এবং তারা আত্মবিশ্বাসী যে যুক্তরাজ্য তা মেনে নেবে।
কাতারের রাজধানীতে আলোচনার পর মুত্তাকি আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বখতারকে বলেন, ‘আমরা তাদের স্পষ্টভাবে বলেছি যে, আফগানিস্তানে সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা কারো জন্যই ভালো নয়।’ তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক সবার জন্য ভালো। আফগানিস্তানে বিদ্যমান সরকারকে দুর্বল করার জন্য এমন কিছু করা উচিত নয় যা জনগণের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ডেপুটি স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ টম ওয়েস্ট এবং ইউএসএইড-এর শীর্ষ হিউম্যানিটারিয়ান কর্মকর্তা সারা চার্লসের নেতৃত্বে একটি আমেরিকান দলের সঙ্গে দুই দিনের আলোচনার প্রথম দিনেই মুত্তাকি এই মন্তব্য করেছেন।
মুত্তাকি বলেন, আমেরিকার উচিত আফগানদের ভ্যাক্সিনেশনে সাহায্য করা। তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকা ভ্যাক্সিনেশনে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তিনি আরও বলেন ‘প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে দুই দেশ একে অপরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে এবং আফগানিস্তানের এই কঠিন সময় পার করছে তখন তারা ধৈর্য রাখবে যাতে আফগানিস্তান আরও শক্তির সাথে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে।’ তবে আমেরিকার তরফে এই বৈঠকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। আফগানিস্তানের অর্থনীতিও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ, খাবারের দাম বাড়ছে এবং বেকারত্ব বাড়ছে। মুত্তাকি বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের অসুবিধা নিয়ে আলোচনার জন্য অন্যান্য দেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই ধরনের বৈঠক এবং সমাবেশ করার চেষ্টা করছি এবং আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে, একে অপরের মতামত শুনতে চাই।’ তিনি বলেন, অর্থনীতি বা অন্য কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের জনগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা সমাধান করা উচিত। আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার অন্যান্য রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এবং অন্যদের সাথে সহযোগিতা করতে, তার জনগণের সুবিধার্থে এবং তাদের সেবা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আলোচনার সময় তালেবান প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রকে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন, কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা টেলিভিশনের প্রতিবেদনে মুত্তাকি বলেছেন। মন্ত্রী আরও বলেন, আফগান প্রতিনিধি দল এবং মার্কিন সমকক্ষরা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ‘একটি নতুন পাতা খোলার’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার আগে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা বলেছিলেন যে, তার অগ্রাধিকার ছিল আমেরিকা এবং অন্যান্য নাগরিক যারা আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চায় তাদের নিরাপদ প্রবেশপথ নিশ্চিত করা এবং তালেবানরা যাতে আফগানিস্তানের মাটিতে ‘সন্ত্রাসীদের’ কাজ করার অনুমতি দেয় না। তিনি বলেন, ‘এই সভা স্বীকৃতি প্রদান বা বৈধতা প্রদানের বিষয়ে নয়। আমরা স্পষ্ট যে তালেবানদের নিজস্ব কর্মের মাধ্যমে যে কোন বৈধতা অর্জন করতে হবে।’
এদিকে, তালেবানের ভারপ্রাপ্ত তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নূর মোহাম্মদ মুতাওয়াকেল বলেছেন, ‘ব্রিটেন আমাদের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত এবং আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। যুদ্ধে জড়িত অন্যান্য দেশকেও অর্থ প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ ব্রিটিশ সরকারের একটি সূত্র বলেছে, ‘আমরা জানি না তারা কী চাইবে। কিন্তু এটি জড়িত প্রত্যেকের জন্য কোটি কোটি ডলার হতে পারে। আমরা তা পরিশোধ করি বা না করি তা আলাদা বিষয়।’ বর্তমানে আফগানিস্তানের অর্থনীতি একেবারে তলানীতে। দেশটির জিডিপি এই বছর ১০ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ সালে ৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হতে চলেছে। অনেক বিদেশী শক্তি তাদের দেশে থাকা আফগান সম্পদ বাজেয়াপ্ত করছে – শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ৭০০ কোটি পাউন্ড আটকে রয়েছে।
আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাবেক কমান্ডার কর্নেল রিচার্ড কেম্প বলেছেন, ‘বৈধ সরকারকে সমর্থন করার জন্য আফগানিস্তানে যুদ্ধ করা দেশগুলোর কাছ থেকে যে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে তালেবান, তা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি বলেন, ‘তালেবানদেরকে ব্রিটিশ সরকারের একটি পয়সা দেয়ার কথাও চিন্তা করা উচিত নয়। দেশকে ধ্বংসের দিকে চালিত করতে সক্ষম শাসনের কাছ থেকে এটি অনেক দাবির মধ্যে প্রথম হবে।’ কূটনীতিকরা তালেবানদের সাথে বৈঠক করেছেন যাতে যুক্তরাজ্যের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা নিরাপদে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কেউ কেউ আশঙ্কা করে যে, তালেবানরা ক্ষতিপূরণের জন্য আলোচনায় তাদের ব্যবহার করতে পারে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কর্নেল ফিলিপ ইনগ্রাম বলেন, ‘যুক্তরাজ্য খুবই কঠিন অবস্থানে রয়েছে। আমি মনে করি না যে, তাদের অর্থ প্রদান করা উচিত কিন্তু এটি গুরুত্বপূর্ণ যে কোন দেশ অর্থ প্রদান করে না কারণ ঐক্যের অভাবকে কাজে লাগানো হবে। তালেবানরা খুব বিচক্ষণ।’ তিনি বলেন, ‘প্রত্যাহারের মধ্যে তারা বিবৃতি দিতে থাকে। তারা জানত পশ্চিমা সরকার শুনতে চায়। এখন সাহায্য কাটা হয়েছে এবং তাদের নগদ অর্থের প্রয়োজন, তারা তাদের মেসেজিংয়ের মাধ্যমেও একই কাজ করছে এবং সম্ভবত এটি মানুষকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার সাথে যুক্ত করবে।’
ব্রিটশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায় কিন্তু নিশ্চিত করেছে যে বেসামরিক হতাহতের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘প্রতিটি বেসামরিক মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি। যুক্তরাজ্য কঠোর টার্গেটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সেই ঝুঁকি কখনই পুরোপুরি দূর করা যায় না।’ মন্ত্রণালয়ের তথ্য দেখায় যে, ২০০৬-১৩ সালের মধ্যে ২৮৯জনের মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছিল। সেখানে একটি পরিবার পেয়েছে মাত্র ১০৪ দশমিক ১৭ পাউন্ড বা প্রায় ১২ হাজার ১২৮ টাকা। সামগ্রিকভাবে, ৬ লাখ ৮৮ হাজার পাউন্ড বা প্রায় ৮ কোটি ৯৭ হাজার টাকা। একটি পরিবার ১০ বছরের ছেলের মৃত্যুর জন্য ৫৮৬ দশমিক ৪২ পাউন্ড বা প্রায় ৬৮ হাজার টাকা পেয়েছে। অপর একটি পরিবার তাদের গাধার পালের মৃত্যুর জন্য ৬৬২ পাউন্ড বা প্রায় ৭৭ হাজার টাকা পেয়েছে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করেছে তালেবান। আগস্টে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের সাথে প্রথম সরাসরি আলোচনার আগে একটি মূল ইস্যুতে তালেবান তাদের আপোষহীন অবস্থান তুলে ধরেছে। তালেবানের রাজনৈতিক মুখপাত্র সুহেল শাহীন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান সক্রিয় ইসলামিক স্টেট গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের সাথে কোন সহযোগিতা হবে না। গত শুক্রবার আফগানিস্তানের কুন্দুজ শহরের একটি শিয়া মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ১০০ লোক হতাহত হয়েছেন। তবে এর মধ্যে ৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এটি সহ সাম্প্রতিক কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এ প্রসঙ্গে শাহীন বলেন, ‘আমরা স্বাধীনভাবে আইএস’র মোকাবেলা করতে সক্ষম।’ সূত্র : ইউকে মিরর, এপি, ডন।