বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
বরফে জমে স্বপ্নের মৃত্যু: দালালচক্র এখনও সক্রিয়, পরিবার চায় সন্তানের লাশ

বরফে জমে স্বপ্নের মৃত্যু: দালালচক্র এখনও সক্রিয়, পরিবার চায় সন্তানের লাশ

amarsurma.com

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
স্বপ্নের দেশ ইউরোপের গ্রিসে গিয়ে নিজের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণের চেষ্টার শেষ সারথি হলো বরফে জমে মৃত্যু। ২২ জনের অভিবাসন প্রত্যাশীর একটি দল গ্রিসের সীমান্ত পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছিল। অভিবাসন প্রত্যাশীর ওই দলটিতে ছিল সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তিন যুবক। গত বৃহস্পতিবার তুরস্ক-গ্রিস সীমান্ত থেকে ১২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর লাশ উদ্ধার করেছে তুরস্কের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। দেশটির এর্ডিনা প্রদেশের ইপসালা গ্রামে ঠাণ্ডায় জমে পড়েছিল লাশগুলো। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হলে যুবকদের পরিবারে শোকের মাতম চলছে। কিছু সূত্র থেকে নিখোঁজ তিন যুবকের মৃত্যু হয়েছে এমন সংবাদ পাওয়া গেলেও নিশ্চিত হতে পারেনি পরিবারগুলো। প্রিয় সন্তানদের খোঁজ পেতে পাগলপ্রায় পিতারা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।
নিখোঁজ যুবকদের পরিবারের লোকজন জানান, গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের টুকদিরাই গ্রামের বাসিন্দা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য এনামুল হকের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বাড়ি ছাড়েন দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের সাকিতপুর গ্রামের ফুল মিয়া সরদারের ছেলে জনি সরদার (৩৪), নতুন কর্ণগাঁও গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে জুনেদ আহমেদ (২২) ও শাল্লার আনন্দপুর ইউনিয়নের আশুতোষ রায়ের ছেলে আকাশ রায় (২৫)। তবে জনি সর্দার মারা যাওয়ার ব্যাপারে পরিবারের কেউই নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন তারা।
আকাশ রায় দিরাই উপজেলার কল্যাণী গ্রামের বাসিন্দা ও দিরাই বাজারের ব্যবসায়ী বিধান রায়ের ভাগ্নে। মানব পাচারকারী এনামুল হক ওই যুবকদের দুবাই, ইরান, তুরস্ক হয়ে গ্রিসে পৌঁছে দেয়ার চুক্তি করেছিল। এজন্য বাংলাদেশ থেকে দুবাই ২ লাখ টাকা, দুবাই থেকে ইরান ৩ লাখ টাকা, ইরান থেকে তুরস্ক ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও তুরস্ক থেকে গ্রিস পর্যন্ত আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেয় পাচারকারী এনামুল।
এদিকে সাকিতপুর গ্রামে ফুল মিয়া সরদারের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। কিছু পত্রিকায় ইতিমধ্যে ফুল মিয়া সরদারের ছেলে জনি সরদারের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে। তবে তিনি এখনো নিশ্চিত হতে পারেন নি। দালাল এনামুলও স্পষ্ট কিছু বলছে না বলে জানান তিনি।
নিখোঁজ যুবক জুনেদ আহমেদের পিতা লাল মিয়া জানান, আমার ছেলেকে দুবাই-ইরান হয়ে তুরস্ক পৌঁছায় এনামুল। গত ৩১ জানুয়ারি সোমবার আমার ছেলের সাথে শেষবার কথা হয়। তুরস্ক থেকে এনামুলের লোকজন গাড়িতে করে গ্রিসে পৌঁছে দিবে জানিয়ে আমার ছেলে এনামুলের টাকা দিয়ে দিতে বলে। ওইদিনই দিরাই বাজারে বিধান রায়ের দোকানে বসে আমার ছেলে জুনেদ ও বিধান রায়ের ভাগ্নের তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছে দেয়া বাবদ সর্বশেষ চুক্তির মোট ৭ লাখ টাকা আমি ও বিধান বাবু এনামুলের ভাগ্নে শাহজাহানের হাতে তুলে দেই। এরপর থেকে আমার ছেলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। দালাল এনামুল প্রথমে আশ্বাস দিলেও এখন তার সাথে কথা বলতেই পারছি না।
হাইমাউ করে কেঁদে তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি-আমার ছেলে নাকি মারা গেছে। যদি মারা গিয়েই থাকে তবে তার লাশটা ফিরে পেতে সরকারের কাছে হাতজোড় করে মিনতি জানাই’।
ব্যবসায়ী বিধান রায় বলেন, ‘গত সোমবারের পরে আমার ভাগ্নের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মৃতদের যে ছবি দেখা গেছে সেখানে আমার ভাগ্নে নেই। এনামুল জানিয়েছে, বর্ডারে সবাই মরেনি। কিছু লোক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। আমার ভাগ্নে হয়তো সেখানে থাকতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানাবে বলেছে’।
মানব পাচারকারী এনামুলের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে এর আগেও ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ গেছে দিরাই পৌর সদরের চণ্ডিপুর গ্রামের মাস্টার আব্দুস সবুর মিয়ার ছেলে মাহবুবুল করিমের।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার টুকদিরাই গ্রামের হাজি আব্দুল ওয়াহেদ মিয়ার ছেলে এনামুল হক এক সময় ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হঠাৎ সে ঢাকা-সিলেট আসা-যাওয়া করে এলাকার যুব সমাজকে ইউরোপ পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে মানবপাচার শুরু করে। স্বপ্নের ইউরোপ পাড়ি দিতে লাখ লাখ টাকা নিয়ে এনামুলের শরণাপন্ন হয় এলাকার অনেকে। দীর্ঘদিন অবৈধভাবে মানবপাচার করে কোটিপতি হয়ে ওঠে এনামুল। সিলেট শহরে বাড়ি-গাড়ি করে এনামুল। এনামুলের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ স্বপ্নের ইউরোপ পাড়ি দিলেও অনেকের সলিল সমাধি হয়েছে ভূমধ্যসাগরে কিংবা কাঁটাতারের সীমান্তে। কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে লিবিয়া-ইরান-তুর্কি থেকে দেশে ফিরছে, কেউ বা জেল খেটেছে।
এদিকে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য এনামুল হক নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য সাম্প্রতিককালে সে মিডিয়া জগতে প্রবেশ করেছে। একটি অনলাইন পত্রিকার চেয়ারম্যান হিসেবেও তাকে দেখানো হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদকও নানা দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলেও জানা যায়। ভূক্তভোগিদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে এসব অপরাধ কমে যাবে। আর তাদের খপ্পরে পড়ে কোন মা-বাবার বুক খালি হবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com