শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৮ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক:
স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাড়ি জমাতে যাওয়ার পথে নৌকাডুবে নিহতদের মধ্যে সিলেটের নাগরিক রয়েছেন ১৫ জন। নিহত ৬০ জনের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশি বলে জানা গেছে।
সিলেটের নিহত নাগরিকদের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন- সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই শামীম আলম, সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আহমদের ছোট ভাই মারুফ আহমদ, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর এলাকার মুয়িদ পুর গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজ (২৫), একই গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে আহমদ (২৪) এবং সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন (২৪)। এ ঘটনায় ফেঞ্চুগঞ্জের দিনপুর গ্রামের আরেকজন নিহত হয়েছে। আর অপর ৯ জনের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
তিউনিসিয়া রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থাগুলো বলছে, বৃহস্পতিবার ভূমধ্যসাগরে এক নৌকা ডুবিতে নিহত প্রায় ৬০ জন অভিবাসীর অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশি নাগরিক।
বেঁচে যাওয়া লোকজন তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টকে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে লিবিয়ার উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসী একটি বড় নৌকায় করে ইটালির উদ্দেশে রওনা হন। গভীর সাগরে তাদের বড় নৌকাটি থেকে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটি নৌকায় তোলা হলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি ডুবে যায়।
তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মঙ্গি স্লিমকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, রাবারের তৈরি ‘ইনফ্লেটেবেল’ নৌকাটি ১০ মিনিটের মধ্যে ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার জেলেরা ১৬ জনকে উদ্ধার করে শনিবার সকালে জারযিজ শহরের তীরে নিয়ে আসেন।
উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা জানান, সাগরের ঠান্ডা পানিতে তারা প্রায় আট ঘণ্টা ভেসে ছিলেন। উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের ১৪ জনই বাংলাদেশি। যে ১৬ জনকে শনিবার সকালে সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের একজন সিলেটের আহমেদ বিলাল। ওই নৌকায় আরও কয়েকজন সিলেটের নাগরিক ছিলেন বলে জানা গেছে।
ত্রিপলিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সিকান্দার আলী বলেন, তারা দুর্ঘটনার কথা জানেন এবং তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যত দ্রুত সম্ভব তারা জারযিজে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
অভিবাসীদের ভাষ্যমতে, নৌকাটিতে ৫১ জন বাংলাদেশি ছাড়াও তিনজন মিশরীয় এবং মরক্কো, শাদ এবং আফ্রিকার অন্যান্য কয়েকটি দেশের নাগরিক ছিলেন।
ভূমধ্যসাগরে বড় বোট থেকে ছোট একটি প্লাস্টিকের বোটে তোলা হলো প্রায় ৭৫ জন অভিবাসীকে। তাতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। গাদাগাদি করে তাতেই উঠতে হয় তাদের। এর ১০ মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায় বোটটি। আর চোখের সামনে একে একে মানুষ নির্মমভাবে মরতে থাকেন। সাহায্যের জন্য করুণ আকুতি তখন সমুদ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। দূরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে সেই আহাজারি। কিন্তু শূণ্য সমুদ্রে তাকিয়ে তাকিয়ে স্বজনের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না বাংলাদেশী অভিবাসী আহমেদ বিলালের (৩০)।
তার বাড়ি সিলেট অঞ্চলে। এমন মৃত্যু আর ভয়াবহতা দেখে তিনি চিৎকার শুরু করেছিলেন। বলেছেন, বয়সে ছোট আমার দুই নিকট আত্মীয় পানিতে হারিয়ে গেলো। তাকিয়ে দেখলাম আর চিৎকার করলাম। কান্না থামাতে পারছিলাম না কোনোভাবে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন টিআরটি।
তিউনিশিয়া উপকূলে নৌডুবিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৬০ অভিবাসী। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশী। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১৬ জনকে। তার মধ্যে ১৪ জনই বাংলাদেশী বলে জানাচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট। তাদের অন্যতম আহমেদ বিলাল। তিনি বলেছেন, ৬ মাস আগে থেকে তার ইউরোপ যাত্রার মিশন শুরু হয়েছিল। অন্য তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে যান দুবাইয়ে। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুল থেকে তারা একটি ফ্লাইটে করে চলে যান লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি। বিলাল বলেন, সেখানে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশীর সঙ্গে যোগ দিই আমরা। আমাদেরকে তিন মাস লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায় মনে হয়েছিল, ওই লিবিয়াতেই বুঝি মারা যাবো। দিনে মাত্র একবার আমাদেরকে খাবার দেয়া হতো। তাও পরিমাণে কম। এই ৮০ জন মানুষের ব্যবহারের জন্য ছিল মাত্র একটি টয়লেট। আমরা গোসল করতে পারতাম না। পারতাম শুধু মুখ ধুতে। দিনরাত শুধু কাঁদতাম আমরা। খাবার চেয়ে কান্নাকাটি করতাম।
আহমেদ বিলালের যখন বাড়ি ছাড়েন তখন আন্দাজ করতে পারেন নি এই সফরের পরিণতি কি হতে পারে। সিলেটে থাকা অবস্থায় তিনি দেখেছেন বহু মানুষ ইউরোপে বসবাস করছেন। তারা উন্নত জীবন যাপন করছেন। তা দেখে তিনি প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। তাই জমি বিক্রি করেছেন। ‘গুড লাক’ ডাকনামের এক বাংলাদেশী পাচারকারীর হাতে এই সফরের জন্য দুই সন্তানের জনক বিলাল তুলে দিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার ডলার। তিনি বলেন, ওই পাচারকারী বলেছিল, আমার জীবন উন্নত হবে। সব পাল্টে যাবে। আমরা তাই বিশ্বাস করেছিলাম। আমি নিশ্চিত তিনি এই পথে যত মানুষ পাঠিয়েছেন তার বেশির ভাগই মারা গেছেন।
ডুবে যাওয়া ওই বোটে ছিলেন মিশরের নাগরিক মানজুর মোহাম্মদ মেটওয়েল্লা (২১)। তিনি বলেন, আমাদেরকে বড় বোট থেকে ছোট বোটে নামানো হলো। এর পর পরই তা ডুবে যেতে শুরু করে। আমরা সারারাত সাঁতার কাটতে থাকি হিম ঠাণ্ডা পানিতে। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন সিলেটের বিলালও। তিনি বলেছেন, এক পর্যায়ে বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে ওই জেলেদের। তাদের বদৌলতে আমরা জীবন ফিরে পেয়েছি। জেলেরা উদ্ধার করেছেন ১৪ জন বাংলাদেশী, মরক্কোর একজন নাগরিক ও মিশরের মেটওয়েল্লাকে। এ জীবনকে তারা দ্বিতীয় জীবন বলে আখ্যায়িত করছেন। এ জীবনেও এক অন্ধকার ভবিষ্যত বিলালের সামনে। তিনি বলেন, আমি সবকিছু হারিয়েছি। এখন আমার আর সম্বল বলতে কিছুই নেই। তাই জীবন বাঁচাতে, পরিবারকে বাঁচাতে এখনও আমি অর্থ উপার্জনের জন্য ইউরোপে যেতে যাই। যে ঝুঁকি নিয়েছি, সেভাবে আর যেতে চাই না।
দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ)ণ্ডএর হিসাবে লিবিয়ায় ৬০০০ অভিবাসীকে আটক করে রাখা হয়েছে এমন এক অবস্থায় যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে অনেক নিচে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার খলিফা হাফতার গত মাসে ত্রিপোলিকে দখলে নেয়ার অভিযান শুরু করেন। এতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সেনা বাহিনীর সঙ্গে এ লড়াইয়ে কমপক্ষে ৪৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবে নিহতদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি।
এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাননি জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, উদ্ধার হওয়া ১৪ জনের সবাই বাংলাদেশি। যাদের এখনও পাওয়া যায়নি। এছাড়া নিহতদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই।’
‘যেহেতু ৩৭ জনকে পাওয়া যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৩৫ জন মারা গেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যোগ করেন ড. মোমেন।
এ ঘটনা জানার পর লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এক কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে চলে গেছেন বলে জানানও মন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘নিখোঁজদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। যারা উদ্ধার হয়েছেন তাদের দেশে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
তবে শনিবার লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বার্তা অনুযায়ী ওই নৌকায় ৫১ জন বাংলাদেশি ছিলেন বলে জানার আবদুল মোমেন।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে লিবিয়ার উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসী নিয়ে একটি বড় নৌকা ইটালির উদ্দেশে রওনা হয়। গভীর সাগরে তাদের বড় নৌকা থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি নৌকায় তোলা হলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। নৌকাডুবিতে নিহত ৬০ জনের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশি।