সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩০ অপরাহ্ন
সাইফ উল্লাহ, বিশেষ সংবাদদাতা (সুনামগঞ্জ): প্রাণপণ চেষ্টাতেও শেষ রক্ষা হয়নি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের মাটিয়াইন হাওরের বোরো ফসলী ৩২’শ হেক্টর আয়তনের সবুজ ধানী হাওরটির। রাতেও হাওরের শতাধিক গ্রামের দশ হাজার কৃষকের আশা ছিল মঙ্গলবার আকাশে রোদ দেখা দিলে হয়ত আবাদকৃত ধান গোলায় তোলা যাবে, কিন্তু সব আশাই যেন গুড়েবালি হয়ে গেল। উপজেলার মাটিয়াইন হাওরের ৩২’শ হেক্টর আবাদকৃত সবুজ কাঁচা ধান মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ডুবতে থাকল। আশেপাশের কান্দায় লাগানো বোরো ধানসহ প্রায় ৪০ কোটি টাকার কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে গেল মঙ্গলবার সকালে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার মাটিয়াইন হাওরের কাউকান্দি ও বড়দল গ্রামের মধ্যবর্তী আলমখালী ও বড়দল গ্রামের পাঁচ নাইলন্দ্রা এ দুটি বেড়িবাঁধ উপচে কেন্দ্রয়ার নদীর পানি প্রবেশ করতে থাকে হাওরে সকাল থেকেই। দুপুর ২টা নাগাদ পুরো ৩২’শ হেক্টর আয়তনের বিশাল হাওরে কাঁচা সবুজ ধানের ওপর দিয়ে হাওরের অথৈ পানি ঢেউ খেলছে আর এসব ঢেউয়ের আঘাত লাগছে দরিদ্র কৃষকদের বুকে।
মাটিয়াইন হাওরপাড়ের কৃষক কাউকান্দি গ্রামের শামসুল হক মঙ্গলবার তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, শতাধিক গ্রামের কৃষক গত ৬ থেকে ৭ দিন ধরে নিজের যা সম্বল ছিল তা দিয়ে হাওরের বাঁধ রক্ষা করতে দিনরাত মাটি, বস্তা-খটি দিয়ে গেছি। তিনি আরো বলেন, মাটিয়াইন হাওরকে ঘিরে এই এক ফসলী বোরো ধানের উপর আমার মত উপজেলার ৫ ইউনিযনের ১০ হাজার কৃষকদের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকেই সেই অবলম্বনটুকু কেড়ে নিল অনাকাঙ্কিত বৃষ্টির পানি।
উপজেলার বড়দল গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, ভাই এই হাওরের ফসল দিয়া আমাদের সারা বছরের (এক বছর) খোরাকি (খাওয়ান) চলে, এরপর বাড়তি ধান বেইচ্ছা (বিক্রি) করে বাড়ির ছেলে-মেয়ের বিয়া সাদি, দুইড্যা ঈদ করি, বাড়ির ঘর ঠিক করি, কাপড়-ছোপড় কিনি, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার আর পিআইসির লোকদের কারণে আজ ঘরে ঘরে আহাজারি ও কান্নার রোল পড়ছে। আল্লাহ এদের বিচার করবাইন, আইন তো করবে না জানি।
উপজেলার কাউকান্দি গ্রামের ৯০ বছর বয়সী হাজেরা বেগম বলেন, ‘ও বাবা কিতা কইতাম রে চোখের সামনে সকালে নু পানিতে সাদা হইল মাটিয়াইন হাওর, সোমবারেও নো সারা দিন দেখছি আস্থা (পুরো) হাওর জুইড়া কওচ্চ্যা (সবজু) ধানের গোছা, হায়রে আল্লাহ! তুমি আমরারে বাচাঁও, যারা বান্দের টেখা (টাকা) মাইরা খাইছে (বেড়িবাঁধের) তারার বিচার কর! একথা বলে মঙ্গলবার সকাল থেকেই গ্রামের কৃষকদের বাড়ি বাড়ি হেঁটে বিলাপ করছিলেন ওই বয়োবৃদ্ধা মহিলা।’
উপজেলার বড়দল দক্ষিণ ইউপি চেয়ারম্যান আজহার আলী বলেন, ‘মাটিয়াইন হাওরের নির্ধারিত বেষ্টনি ছাড়াও হাওরের আশেপাশের কান্দায় আরো প্রায় ৮ থেকে ৯’শ হেক্টর জমিতে এ মৌসুমে অধিক ফলনের আশায় কৃষকরা বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু সব কিছুই তো মঙ্গলবার সকালে শেষ হয়ে গেলে এখন শুধু হাওরপাড়ের দশ হাজার কৃষকের ঘরে ঘরে আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক মঙ্গলবার মাটিয়াইন হাওর ডুবির ঘটনা নিশ্চিত করে বলেন, মাঠিয়াইন হাওরে প্রায় ৩২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয় চলতি মৌসুমে, এ হাওর তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের প্রায় ৩২ কোটি টাকা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি হিাবে ৩২ কোটি ফসল হানি হলেও এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে স্থানীয় কৃষকরা নিশ্চিত করেছেন।