শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২২ অপরাহ্ন
হাবিব সরোয়ার আজাদ: উপজাতী পল্লীঘেঁষা মেঘালয় পাহাড় থেকে প্রবাহিত সুনামগঞ্জ সীমান্তের ‘লালঘাট ঝরণা ধারা’ প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণ পিপাসু ও পর্যটকদের নিকট এখন বেড়ানোর নতুন ঠিকানা। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের নিকট কয়েক যুগ ধরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ১৭টি দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান পরিচিতি পেলেও তাদের দৃষ্টির অঘোচরেই রয়ে গিয়েছিলো লালঘাট উপজাতী পল্লীর ‘লালঘাট ঝরণা ধারা’।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার হাওর সীমান্তঘেষা প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য খ্যাত তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড়ে হযরত শাহজালাল (রহ)-এর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সঙ্গি ইসলাম প্রচারক হযরত শাহ আরেফিন (রহ)-এর আস্থানা। সীমান্তনদী জাদুকাঁটা, বারেকটিলা, হাজি জয়নাল আবেদীন গার্ডেন, শ্রী অদ্বৈত আচার্য্য প্রভুর রাজারগাঁওর আখড়া বাড়ি পণতীর্থ ধাম, গড়কাটি ইসকন মন্দির, কড়ইগড়া, রাজাই উপজাতী পল্লী, ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প, প্রকল্প ঘেষা শহীদ সিরাজ বীরউত্তম লেক, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয় ঘেঁষা ঝরণা ও টিলা, লাকমা ছড়া, বড়ছড়ার ভাঙ্গারঘাট চুনাপাথর কোয়ারী, বড়ছড়া, চারাগাঁও, বাগলী স্থল শুল্ক স্টেশন ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেইজ রামসার প্রকল্পভুক্ত গাছ-মাছ অতিথি পাখির অভয়াশ্রম দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবনখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর দর্শনীয় স্থানগুলো দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের নিকট কয়েক যুগধরে পরিচিতি পেলেও তাদের দৃষ্টির অঘোচরেই রয়ে গিয়েছিলো উপজেলার শ্রী উত্তর ইউনিয়নের বালিয়াঘাট-চারাগাঁও সীমান্তের মধ্যবর্তী লালঘাট উপজাতী পল্লী ঘেঁষা মেঘালয় পাহাড় থেকে প্রবাহিত হয়ে নেমে আসা ‘লালঘাট ঝরণা ধারা’।
জেলা শহর সুনামগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিাটার (নৌপথ) এবং ২২ কিলোমটির (সড়কপথ) উপজেলার সোজা উত্তরমুখি শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের সীমান্ত সড়কের লাগোয়া উপজাতী পল্লী লালঘাটের অবস্থান। সীমান্তের ১১৯৬ মেইন পিলারের ভারত-বাংলাদেশ জিরো পয়েন্ট দিয়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সবুজের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে এসে ‘লালঘাট ঝরণা ধারার’ স্বচ্ছ সাদা পানি নামছে এপারের পাহাড়ি ছড়ার মুখে। পাহাড়ি ছড়ার পানির স্রোতধারা অবিরাম গতিতে নেমে এপারের লালঘাট গ্রামের পশ্চিম দিকের আঁকা-বাঁকা ছড়া হয়ে মিশে যাচ্ছে সংসার হাওরের মিটাপানির সাথে।
লালঘাট ঝরণা ধারার পূর্বঘেঁষা উপজাতী পল্লীর হাজং সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ছোট ছোট পরিবারের বসবাস। এ গ্রামটিকে বলা হয় সবুজের গ্রাম। বসতির চারপাশে রয়েছে পাহাড়ি বনজ ফলজ ও ফুলের গাছ-গাছালী। উপজাতী পল্লী হলেও লালঘাটে রয়েছে দেড় শতাধিকের উপর স্থানীয় বাঙালি পরিবারের বসবাস। এখানে বাঙালী ও উপজাতী দু’ধর্মের লোকজনের সহাবস্থান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আরেক খন্ড চিত্র দেখা যাবে। উভয় ধর্মের উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই খুবই অতিথি পরায়ন। গ্রামবাসীর সহযোগীতা নিয়ে দেখা যাবে প্রকৃতির আরেক দৃষ্টি নন্দন ‘লালঘাট ঝরণাধারা’ ও এর আশপাশে থাকা সীমান্ত প্রকৃতির অপরূপ রূপ। গ্রামের পাশে এপারে দাঁড়িয়ে দেখা যাবে ভারতীয় সীমানায় থাকা চুনাপাথরের পাহাড়, ভারতীয় লালঘাট বিএসএফ জোয়ানদের ক্যাম্প, মাইলের ও পর মাইল জুড়ে থাকা কাঁটাতারের প্রতিরক্ষা বেড়া, মেঘালয় রাজ্যের শিলং যাতায়াতাতের জন্য মহাসড়কে চলাচলকারী চারচাকার বাহনের ছোট-বড় বহর।
দেশ-বিদেশের যে সব পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুরা জেলা সদর কিংবা তাহিরপুর উপজেলা সদর হয়ে প্রকৃতি দর্শনে জাদুকাঁটা, বারেকটিলা ও টেকেরঘাট চুনাপাথল খনি প্রকল্প, শহীদ সিরাজ বীরউত্তম লেক ও লাকমা ছাড়া বেড়াতে আসেন, তারা টেকেরঘাট থেকে মাত্র ৩ কিলোমিাটার পথ পশ্চিমে এগিয়ে গেলেই দেখা পাচ্ছেন লালঘাট উপজাতী পল্লীর ‘লালঘাট ঝরণা ধারা’।
উপজেলার লালঘাট উপজাতী পল্লীর নারীনেত্রী শ্রী মতি অনুরাধা দেবী হাজং ও লালঘাট গ্রামের হাসান আলী জানান, কয়েক যুগ ধরে লোক চক্ষুর আড়ালেই ছিল ‘লালঘাট ঝরণা ধারার’ অপরূপ রূপ। তারা আরো বলেন, ২০১৪ সাল থেকে যুগান্তর স্বজন সমাবেশের তাহিরপুর উপজেলার স্বজনরা, পরিবেশ ও মানবাধিকার উন্নয়ন সোসাইটির উপ-পরিচালক দৈনিক যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার হাবিব সরোয়ার আজাদসহ তার সহকর্মীরা প্রতি বছর ইংরেজি, বাংলা-নববর্ষ, দুটি ঈদ ও পুজায় এখানে বেড়াতে আসার পর থেকেই এলাকার ও বহিরাগত পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের যাতায়াত অতীতের যে কোন সময় থেকে অনেকটা বেড়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্জ আবুল হোসেন খান এবং শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ খসরুল আলম খসরু বলেন, সরকারিভাবে অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টি হলে সিলেটের মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে যেমন দেশ-বিদেশের লোকজন প্রতিনিয়ত জড়ো হন, ঠিক সেভাবেই ‘লালঘাট ঝরণাধারা’ দেখতেও পর্যটক ভ্রমণ পিপাসুরা দিনে দিনে ভীড় জমাবেন, এতে স্থানীয় সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের লোকজনের মধ্যে পর্যটক বান্ধব নতুন এক কর্মস্থানের সৃষ্টি হবে।
সুনামগঞ্জ-২৮ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ পিএসসি বললেন, লালঘাট ঝরণাধারা দেখতে খুবই অপরূপ দৃষ্টিনন্দন, তবে এটির অবস্থান ভারত- বাংলাদেশ জিরো পয়েন্টে থাকায় সীমান্তের দায়িত্বপুর্ণ চারাগাঁও বিওপির বিজিবিকে অবহিত করে বাংলাদেশ সীমানায় অবস্থান করে যে কোন দর্শনার্থী কিংবা পর্যটক সেখানে যেতে কোন বাঁধাই নেই কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে কোন অবস্থানেই কেউ যেন ভারতীয় সীমানায় অনুপ্রবেশ না করেন।
লেখা ও ছবি: হাবিব সরোয়ার আজাদ, গণমাধ্যকর্মী, উপ-পরিচালক পরিবেশ ও মানবাধিকার উন্নয়ন সোসাইটি ঢাকা-বাংলাদেশ।