শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৩ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : সদ্য প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ছিলেন এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।২০০১ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের নিয়ে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে বসেছিলেন। তখনই একজন তৃণমূলের নেতা বলেছিলেন আমাদের এই পরাজয়ের প্রধান কারণ মন্ত্রীমহোদয়েরা। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমরা তাদের কাছে ভিড়তে পারিনি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার কারণেই আমাদের এই পরাজয়। এ কথাটি সেদিন দিনের উক্তি হিসেবে দৈনিক প্রথম আলোয় ১ম পাতায় ছাপা হয়েছিল। যিনি এই উক্তি করেছিলেন তিনি সৈয়দ মহসিন আলী। তখন ছিলেন মৌলভীবাজার পৌরসভায় পরপর ৩ বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই নির্বাচনে সিলেট সদর আসনে সাইফুর রহমানকে পরাজিত করেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। পুরস্কার হিসেবে তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। কিন্তু সৈয়দ মহসিন আলী সেবার কোন মন্ত্রীত্ব পাননি। বরং কিছু কারসাজির কারণে তার স্থান হয় জাতীয় সংসদে পেছনের সারিতে। স্থানীয় একজন নেতার কূটচালের কারণে তিনি উপেক্ষিত হন সবখানে। স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে উপেক্ষা প্রদর্শন করে। কিন্তু তিনি ধৈর্য্য ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আবার বিজয়ী হবার পর তাকে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তৃণমূলের এই নেতা সম্মানিত হন তাঁর কাজের জন্য।
সৈয়দ মহসিন আলীর বাবার নাম সৈয়দ আশরাফ আলী। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। মৌলভীবাজার থেকে ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতার আলীপুরে ছিল তাঁর বিশাল বাড়ি। সৈয়দ মহসিন আলীর মায়ের নাম আছকিরুনন্নেছা খানম। আলীপুরের সেই বাড়িতে ১৯৪৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়।
নিজের পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৈয়দ মহসিন আলী বলেন, আমার দাদা সৈয়দ মহরম আলী মৌলভীবাজারে একজন বিত্তশালী মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল বিস্তর জমিজমা। ন্যায়বিচারক হিসেবেও তাঁর খুব নামডাক ছিল। তিনি জমিদার ছিলেন। তাঁর ছেলে সৈয়দ আশরাফ আলী আমার পিতা। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পাস করেন। কাশিনাথ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এটি ছিল মৌলভীবাজার শহরের একমাত্র জাতীয় বিদ্যালয়।
ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক হওয়ায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়লে সরকারি স্কুল থেকেও তাঁর ডাক আসে। কিন্তু শিক্ষকতায় তাঁর মন পড়ে থাকে না। তিনি ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতা চলে যান।
১৯৬৪ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে মৌলভীবাজারে চলে আসেন। কিন্তু সৈয়দ মহসিন আলীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি কলকাতার সেন্টজেবিয়ার্স স্কুলে জুনিয়র কেম্রিজ ও সিনিয়র কেম্রিজ পাস করেন। পরবর্তীকালে আবার বাংলাদেশে এসে বাংলা মাধ্যমে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা থেকে ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। দেশমাতৃকার প্রতি তার মমত্ববোধের কারণে স্বতস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সম্মুখসমরে যুদ্ধচলাকালে গুলিবিদ্ধও হয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সিলেট বিভাগে সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। মৌলভীবাজার মুহকুমার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিতে তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মহসিন আলী।
মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগ যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতাত্তোরকালে তিনিই একমাত্র জননেতা যিনি পৌরসভায় পর পর ৩বার বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ১২ই জানুয়ারি তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করে। সমাজকল্যাণমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছেন। সেখানে এখন বহুমুখী বাস্তবসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা তাঁর পছন্দের বিষয়। অবসরে তিনি বই পড়তে ভালবাসেন। কবি-লেখকদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দেন। দেশের বড় বড় সাংবাদিকদের অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু। এদের মধ্যে আছেন হাসান শাহরিয়ার, সদ্য প্রয়াত জগলুল আহমদ চৌধুরী, মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মহকুমা/জেলা রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি মৌলভীবাজার চেম্বারের সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্বও পালন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটি তাকে ‘আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক-২০১৪’ প্রদান করে এবং ‘হ্যালো কলকাতা’ নামে কলকাতাভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাকে ‘নেহেরু সাম্য সম্মাননা-২০১৪’ পুরস্কারে ভূষিত করে।
সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন স্থানীয় সরকারের আওতায় দেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে পরিবার পরিকল্পনা ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় বলা ও লেখায় সুদক্ষ। সৈয়দ মহসিন আলী সরকারি ও ব্যক্তিগত সফরে ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ মহসিন আলী বিবাহিত এবং তিন কন্যা সন্তানের জনক। তিনি একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। তার সঙ্গীত প্রীতি সর্বজনবিদীত। খেলাধুলা, সংগীত, বইপড়া ও শরীরচর্চা তার প্রিয় শখ।
সৈয়দ মহসিন আলী এক সময় বাংলাদেশ টাইমসের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গান তাঁর প্রিয় একটি বিষয়। ধ্রুপদী, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি থেকে শুরু করে চটুল সিনেমার গান পর্যন্ত তাঁর মুখস্ত। প্রায় ৫ হাজার গানের সংগ্রহ আছে তাঁর স্মৃতিতে। সমাজকল্যাণে তাঁর প্রিয় সংগীত ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’। সমাজকল্যাণে তিনি এভাবেই তাঁর নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
বিচক্ষণ এই রাজনীতিবিদের জন্য রইল আমাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা