মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন
এহতেশামুল হক ক্বাসিমী
শতসহস্র মনীষার পদচারণায় ধন্য হয়েছে সিলেটের মাটি। অজস্র রাহবারের পদধূলিতে পুলকিত হয়েছে চা-বাগানের দেশ সিলেট অঞ্চল। যুগে যুগে পূন্যাত্মাদের পরশ পেয়ে এজনপদ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এমন এক উঁচু মাকাম অর্জন করেছে, যা অন্যান্য অঞ্চলের জন্য ঈর্ষণীয়।
হযরত শাহ জালাল মুজাররাদে ইয়ামানী রাহ. ও তাঁর ত্রিশতাধিক সহচরের আগমনের মধ্য দিয়ে সবুজ বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের গোড়াপত্তন হয়। দ্বীনী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মারকায হিসেবে তখন থেকেই আত্মপ্রকাশ করে সিলেট অঞ্চল। তাদের পরবর্তীতে আরো উর্বর হয়ে উঠে সিলেটের মাটি। ফলে যুগে যুগে জন্ম নেন অনেক মহামানব। শুভাগমন করেন শাহজালালে সানী আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী সহ আরো কত ধর্মবিদ। তারা অগণন বেশুমার। সিলেটের আপামর মানুষ তাদের যথাযথ মূলায়ন করেছে। ফলে তারা সফল হয়েছেন নিজেদের উদ্দেশ্যে ও টার্গেটে,
দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে। বাস্তবতার নিরিখে একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, এই আহলে ইলম পীর-মাশায়েখের কদর করার কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ দ্বীন-দুনিয়ার হর লাইনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। এই আদর্শ অব্যাহত থাকলে সিলেটবাসীর তারাক্কির গতি কোথায় গিয়ে যে ঠেকবে, তা একমাত্র আল্লাহই মালূম!
যেসব মনীষির পদভারে ধন্য হয়েছে সিলেট অঞ্চল, তারা -আগেই বলেছি- সংখ্যায় অনেক অজস্র। শত সহস্র। তাদের অন্যতম একজন হলেন খলীফায়ে হযরত শায়খে রেঙ্গা
মুফাসসিরে কুরআম আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ.। তিনি স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি ‘হবিগঞ্জী হুজুর’ নামে সারা দেশে ব্যাপক পরিচিত। বহুমুখী গুণের অধিকারী এই কীর্তিমান পুরুষ একদিকে যেমন তাঁর তাফসীরে মুক্তা ঝরতো। অন্যদিকে বাতিলের বিরুদ্ধে সৎসাহসী-বজ্রকণ্ঠের অধিকারী এক সমাদৃত ব্যক্তি ছিলেন। অধ্যাপনার জগতে যেমন ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ কিতাব সহীহ বুখারির উস্তায। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে তিনি অনুসন্ধিৎসু পথহারাদের পথপ্রদর্শক হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র অন্যতম খলিফা।
দেশব্যাপী যে কয়জন কুরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞানে পারদর্শী বুযুর্গ আলেম ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে জাতিকে সহিহ রাহনুমায়ী করতে দেশ বিদেশের সর্বত্র চষে বেড়ান তন্মধ্যে শীর্ষতম মহান মনীষী ছিলেন তিনি।
তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার চতুর্থ শায়খুল হাদীস। সামগ্রিক গুণের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ও ব্যাপকতায় তিনি সমকালে এক বিরল দৃষ্টান্ত। সুলুক ও এহসানের এক অতুলনীয় রাহবার।
জন্ম ও বংশ:
তিনি ১৩৫৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৮ সালে হবিগঞ্জের কাঠাখালি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশের দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা শায়খ আব্দুন নূর রাহ.। নানা মাওলানা আসাদুল্লাহ রাহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারির এক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
পিতা-মাতার কাছেই তিনি পড়ালেখা শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন আপন পিতার প্রতিষ্ঠিত কাটাখালী মাদরাসায়। এরপর তিনি হবিগঞ্জের জামেয়া সাদিয়া রায়ধর মাদরাসায় তাঁর মামা হযরত মাওলানা মুখলিসুর রাহমান রাহ.’র কাছে আরবী ব্যাকরণ ও আরবী ভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রাহ.’র শিষ্য। প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি জামিয়া আহলিয়্যা মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে ভর্তি হয়ে সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৬০-৬১ সালে ‘দাওরায়ে হাদীস’ সম্পন্ন করেন।
অতঃপর পাড়ি জমান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ‘জামেয়া আশরাফিয়া লাহোর’ এ দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। এরপর তিনি কানপুর মাদরাসায় হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রাহ.’র কাছে তাফসীরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বাননূরী টাউন করাচি’ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস ইউসূফ বাননূরী রাহ.’র কাছে সাহীহুল বুখারী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা অধ্যয়নের পাশাপাশি তাফসীরুল কুরআন বিষয়েও বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ গমন:
পাকিস্তান থেকে তিনি ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে পাড়ি জমান। ভারত-পাকিস্তান ডিভাইডের ফলে দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানি ছাত্র ভর্তি বন্ধ ছিলো। তাছাড়া তিনি যখন দেওবন্দ পৌঁছেন, তখন ভর্তির সময়ও শেষ। যার ফলে তিনি নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে পারেননি; তবে তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা কারী তায়্যিব রাহ.’র অনুমতিতে দারুল উলূম দেওবন্দে ‘খুসুসী দারস’ (বিশেষ পাঠ) গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহ.’র কাছে সহিহুল বোখারী, শায়খ ইবরাহিম বলিয়াভি রাহ.’র কাছে জামে তিরমিযী, মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ.’র কাছে তাফসীরে বায়যাবী ও কারী তায়্যিব রাহ.’র কাছে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা অধ্যয়ন করেন।
সহীহ বুখারীর সনদ:
শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. পাঁচজন প্রথিতযশা শায়খুল হাদীসের কাছ থেকে বুখারী শরীফের দারস প্রদানের অনুমতি পেয়েছেন। তারা হলেন, হাটহাজারী মাদরাসায় শায়খ আব্দুল কাইয়্যূম রাহ. ও মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ., লাহোরে মাওলানা শায়খ ইদরিস কান্ধলভী রাহ., করাচীতে শায়খ ইউসুফ বানূরী রাহ. এবং দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খ ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী রাহ.। সাহারানপুরের শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.’র কাছ থেকেও বুখারির প্রথামাংশের অনুমতি পেয়েছেন।
কর্মজীবন:
১৯৬৪ সালে কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিন বছর এ মাদরাসায় হাদীস, তাফসীরসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের দারস প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব রাহ.’র নির্দেশে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় দারসে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসেন। এলাকাবাসীর অনুরোধ ও হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র নির্দেশে হবিগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করেন। গতকাল অবধি এ মাদরাসাতেই মুহতামিম ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। অপরদিকে ১৪৪০ হিজরির ২৮ রমজান তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীস হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার তিনি জামেয়ায় বুখারীর প্রথম দরস প্রদান করেন। গতকাল পর্যন্ত জামেয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীস হিসেবে দারসে হাদীসের মসনদে সমাসীন ছিলেন।
তাযকিয়ায়ে নফস:
শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন শায়খের সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক ফয়েয ও বরকত লাভ করেন। প্রথমে তিনি মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ.-’র কাছে বায়আত হন। অবশেষে শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.’র কয়েকজন খলীফার সাথে পরামর্শ, ইস্তেখারা ও দিলের রুজহানের কারণে হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র কাছে বাইয়াত হন। শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. তাসাউফের উপর দীর্ঘদিন রিয়াযত ও মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. তাঁকে ইজাযত প্রদান করেন।
রাজনৈতিক জীবন:
শুধু দারস তাদরীস ও তাযকিয়ায়ে নাফসই নয়; শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী দা.বা. রাজনীতির ময়দানেও সমান অবদান রেখেছেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী আন্দোলনের এক অগ্রজপুরুষ হিসেবে তিনি সারা দেশে নন্দিত। ইসলাম ও মুসলিম জাতির স্বার্থে তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সুবিদিত।
পারিবারিক জীবন:
শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী দা.বা. ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম হযরত মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.’র ৪র্থ কন্যার সাথে ১৯৬৭ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শায়খের ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে। এক ছেলে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বাকি সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
ইন্তেকালঃ
লাখলাখ আশেক, মুতাআল্লিকীন, মুরীদীন, মুহিব্বীন ও তালেবানকে ইয়াতীম বানিয়ে মাওলায়ে হাকীকির ডাকে সাড়া দিয়ে আজ বাদ আছর পরপারে যাত্রা করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন!