শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৭ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেক্স:
বুধবার ৬০ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তী দিয়েগো ম্যারাডোনা। অনেকে তাকে বামপন্থী মনে করলেও নিজেকে কোনওদিন নিজেকে বামপন্থী বলেননি। বরং জানাতেন, তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্ত। বলেছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। মৃত্যু পর্যন্ত আমি ফিদেলিস্তা।’ পাশাপাশি তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র-বিদ্বেষী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে তিনি ‘আবর্জনা’-র সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন।
ভেনেজুয়েলার মার্কিন বিদ্বেষী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুগো চ্যাভেজেরও সমর্থক ছিলেন ম্যারাডোনা। ২০০৭ সালে চ্যাভেজের সাথে সাক্ষাতের জন্য তিনি ভেনেজুয়েলাও গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি সমাজতন্ত্র নিয়ে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। সমালোচনা করেছিলেন পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি প্রকাশ্যেই তার মার্কিন বিদ্বেষী মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি সেইসব কিছুকেই ঘৃণা করি যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। আমি ঘৃণা করি আমার সর্বশক্তি দিয়ে।’ নিজেকে চ্যাভেজে বিশ্বাসী ‘চ্যাভিস্তা’ বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘ফিদেল, চ্যাভেজ যা করে, আমার কাছে সেগুলোই ঠিক।’
এর আগে ২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাটায় সামিট অফ দ্য আমেরিকাস-এ তিনি আর্জেন্টিনায় জর্জ ডব্লিউ বুশের উপস্থিতির বিরোধিতা করে একটি টি-শার্ট পরেছিলেন, যাতে লেখা ছিল ‘স্টপ বুশ’। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে তিনি সেখানে ঘোষণাও করেছিলেন, ‘একজন আর্জেন্টাইন হিসাবে মানব আবর্জনা জর্জ বুশের উপস্থিতি প্রত্যাখ্যান করতে পেরে আমি গর্বিত।’ ম্যারাডোনার বুশবিরোধী মনোভাব সেই সময় আর্জেন্টিনা জুড়ে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছিল, তবে দেশটির অনেক নাগরিকই আমেরিকার সাথে বাণিজ্য চুক্তিতে বাধা দেয়ার জন্য তার উপরে রাগান্বিত ছিল।
ফুটবলের বরপুত্র দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আর্য়ান্সের একেবারে হতদরিদ্র ঘর থেকে চরম ক্ষুধা-আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বিশ্ব ফুটবলকে শাসন করেছেন। তার বাঁ পায়ে যেন ছিল জাদু। বিশ্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের জীবনের পরতে পরতে ছিল দারিদ্র, নিপীড়িন। সেই তিনিই পরবর্তীতে এই নিপীড়িতদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। ফুটবল খেলেও যে দারিদ্র ঘোচানো যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মূলত তাকে দেখেই আর্জেন্টিনার পরবর্তী একটা প্রজন্ম নেশার জগৎ থেকে দূরে সরে পায়ে তুলে নিয়েছিলেন ফুটবল।
কয়েকদিন আগে সার্বিয়ান সংবাদপত্র পলিটিকায় দেয়া এক অকপট সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘বুয়েন্স আর্য়ান্সের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অংশ ফ্যাবেল ফিওরিটোতে আমার জন্ম। অঞ্চলের দারিদ্রের রূপ এখনও আগের মতোই আছে। বন্ধুরা এখনেও সেই আগের মতোই আছে। শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরাই দিনদিন ধনী হয়েছে।’ অকপট স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিলেন, ‘ধনী হওয়ার সুযোগ আমারও ছিলো। কিন্তু আমি সুযোগ নিইনি, কারণ সেটা করতে গেলে আমায় গরিবের পেটে লাথি মেরে তাঁদের কাছ থেকে চুরি করতে হত।’
ম্যারাডোনা মনে করতেন, প্রথম বিশ্বের ধনী দেশগুলিই এই দীনতার জন্য দায়ী। ম্যারাডোনা কুশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তার অভিযোগ ছিল স্বয়ং পোপ থেকে শুরু করে সব দেশের রাজনীতিবিদেরা। তার বক্তব্য ছিল, কেউ গরিবদের পক্ষে কথা বলেন না। বার্লিনের প্রাচীর ধ্বংসের পরে সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে ন’গুণ। কিন্তু তা দেখার কেউ না থাকায় তার আক্ষেপ ছিল। জীবনের শুরুতে একটা সময় আর্জেন্টিনার নব্য উদারনীতিবাদী প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেমকে সমর্থন করতেন তিনি।
কিউবায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানকার বামপন্থী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মারাডোনার পায়ে কাস্ত্রোর প্রতিকৃতির ট্যাটুও ছিল। ডান হাতে ছিল স্বদেশী বিপ্লবী চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি। নিজের আত্মজীবনী এল দিয়েগো উৎসর্গ করেছিলেন যে কয়েকজন মানুষের প্রতি, তাদের মধ্যে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো অন্যতম।
ম্যারাডোনার মৃত্যুতে আর্জেন্টিনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে তিন দিনের শোক পালন করা হচ্ছে। সাবেক এই নাপোলি এবং এফসি বার্সেলোনার খেলোয়ারের কফিনটি বর্তমানে বুয়েন্স আর্য়ান্সের প্রেসিডেন্টশিয়াল প্যালেসে রাখা হয়েছে, যেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র: ইনসাইডার।