শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৩ অপরাহ্ন
স্টালিন সরকার:
গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আবার গণমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে দায়িত্বশীল, নির্ভরশীল ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো প্রিন্ট মিডিয়া। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে পাঠক-পাঠিকা খবর জানতে পারলেও সংবাদপত্রের গুরুত্ব একচুলও কমে যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবর দায়বদ্ধতা হীনভাবে প্রচার হয়। অন্যান্য মিডিয়া সীমাবদ্ধতার কারণে খবরের গভীরতা না। বিশেষ করে খবরের পেছনের খবর, বিশ্লেষণধর্মী খবর পেতে সংবাদপত্রের বিকল্প নেই। বেশিরভাগ সংবাদপত্র প্রিন্ট ভার্ষণের পাশাপাশি এখন অনলাইন সংস্করণ বের করেছে। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনায় প্রিন্ট মিডিয়া বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছে।
করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাবে প্রিন্ট দৈনিক পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ব্যাক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনও কমেছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল সময়মতো পরিশোধ করা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে ছাপানো সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল এখনো একশ কোটি টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে সংবাদপত্রগুলোকে বিল পরিশোধের লক্ষ্যে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের লক্ষ্যে ৫৮টি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সে নির্দেশনার পরও পত্রিকাগুলো বকেয়া বিল পায়নি।
মূলত পত্রিকা বিক্রি কমে যাওয়া, বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া এবং বিজ্ঞাপনের বিল নিয়মিত না পাওয়ায় আর্থিক সংকটের কারণেই ঢাকাসহ সারা দেশে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু পত্রিকা প্রিন্ট ভার্ষণ বন্ধ রেখে এখন শুধু অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠক প্রিয় অনেক পত্রিকা সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। ব্যয় সংকোচন করে পত্রিকা ছাপা চালু রেখেছে। পত্রিকার পাতার সংখ্যা কমানো, ছাপার পরিমাণ কমানো, রঙিন পৃষ্ঠা কমিয়ে দেওয়া, প্রশাসনিক ব্যয় কমানোসহ নানা উপায়ে ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে দেশের প্রিন্ট মিডিয়াগুলো।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার চিকিৎসকদের মতোই সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অন্যমত হলো সাংবাদিক। অথচ সাংবাদিকদের নিদারুণ আর্থিক কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পসহ নানা সেক্টরে করোনায় প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। অথচ সেবা শিল্প হিসেবে পরিচিত সাংবাদপত্রে সে ছোঁয়া লাগেনি। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক একে অপরের পরিপূরক শব্দ। সংবাদপত্র যদি গাছের কান্ড হয় সাংবাদিক হলেন পাতা। সাংবাদিকদের বাঁচাতে হলে আগে সংবাদপত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সংবাদপত্র টিকে থাকলে সাংবাদিক বাঁচবে। করোনা চরম দুর্দিনে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতোই সরকার থেকে সংবাদিকদের ‘কিছু টাকা’ দেয়া হচ্ছে ঠিকই। এটা কার্যত ব্যক্তিগতভাবেই। গতকালও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ১০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে বলে মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলির এই সাংবাদিকতার যুগে সে টাকা মূল শ্রোতের কতজন সাংবাদিক পাবেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া দুস্থ ও কর্মহীন সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা-দানখয়রাত করা যেতে পারে। কিন্তু কর্মজীবী মূল শ্রোতের সাংবাদিকদের পেশায় টিকিয়ে রাখার জন্য সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো দেয়া অপরিহার্য।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত ১৬ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামালের সঙ্গে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদকরা। তারা আসন্ন বাজেটে সংবাদপত্র ছাপানোর প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট কাগজের ওপর কর প্রত্যাহার চেয়েছেন। তারা সংবাদপত্রশিল্পে করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংবাদিকতা আর দশটা পেশার চেয়ে ভিন্ন। এখানে সত্যতা ও দায়িত্বশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সংবাদপত্র সমাজের দর্পণের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সেই দর্পণে যদি জং ধরে সেটাতে কি মুখের স্বচ্ছ ছবি দেখা যায়? অতীতে সংবাদপত্রের জন্য কমমূল্যে নিউজ প্রিন্ট দেয়া হতো। এখন সেটা নেই। ২০১৪ সালে এই শিল্পকে ‘সেবাশিল্প’ ঘোষণা করা হয়। এটা যদি সেবা শিল্প হয় তাহলে সেবাশিল্পে সরকারের প্রণোদনা, নানামুখি আর্থিক-সুযোগ-সুবিধা দেয়া অপরিহার্য। বিগত বাজেট ঘোষণার আগের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কর্পোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বাদ দেয়া, বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর ৪ শতাংশ কমিয়ে ২ শতাংশ করা এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর শূন্য শতাংশ করার দাবি জানিয়েছিল প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকদের সংগঠন নোয়াব। গতবছর করোনা মহামারি শুরু হলে লকডাউনসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সংবাদপত্র। সে সময় এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এ শিল্পের দুর্দিনে চিত্র তুলে ধরে সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘প্রিন্ট মিডিয়া থাকার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যয় সংকোচ করেও এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া যাবে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না’। এমন অবস্থা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগতে আগে কখনো আসেনি উল্লেখ করে সম্পাদক পরিষদ বলে, ‘সংবাদপত্রের পাঠক ও পত্রিকা প্রচার সংখ্যা কমে গেছে। বিজ্ঞাপন ও কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এমন অবস্থাতেও সকল প্রতিক‚লতা সামলে আমরা পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছি। পাঠকদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার কাজ বাধাগ্রস্ত হতে দিইনি। বাংলাদেশে সংবাদপত্র একটি সেবা শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। এর প্রথম লক্ষ্য বৃহত্তর পরিসরে দেশ ও জনগণের সেবা করা। কিন্তু এই লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো সাহায্য ও সহযোগিতা সংবাদপত্র শিল্প কখনো পায়নি। সেবা শিল্প তো নয়ই, মুনাফামুখী সাধারণ শিল্পগুলো যে সহযোগিতা পায় সংবাদপত্রশিল্প তা থেকেও বঞ্চিত। এই সকল অবস্থা বিবেচনা করে সংবাদপত্রগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে, দাবি-দাওয়া পেশ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা গেছে যে সরকারের তরফ থেকে কখনো তা আমলে নেওয়া হয়নি’।
৯২ ভাগ মুসলমানের এই দেশে এখন পবিত্র রমজান মাস। করোনা দুর্যোগে সংবাদপত্রশিল্প চরম দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মুসলমানদের দরজায় কড়া নাড়ছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ অবস্থায় ৫৮ মন্ত্রণালয়ে বয়েকা পড়ে রয়েছে বিজ্ঞাপনের প্রায় শত কোটি টাকা বিল। সংবাদপত্রের সাংবাদিক-কর্মচারীদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ নির্বিঘেœ করা সম্ভব হয় সে লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকা বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধ করা উচিত। একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে এই গণমাধ্যমকে রক্ষার জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা জরুরি। সেই সঙ্গে সংবাদপত্রশিল্প সংশ্লিষ্ট শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি নিয়ে জটিলতা নিরসনে দ্রুত ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। অপ্রিয় হলেও সত্য মাঝে মাঝে কিছু রুগ্ন সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান সংবাদপত্র শিল্পের কোনো উপকারে আসে না।
সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব