সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৮ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক:
দেশে কাজের ক্ষেত্র না থাকায় কাজের সন্ধানে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব অনুপ্রবেশকারী ইউরোপে প্রবেশ করেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশিরা। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর অনুপ্রবেশকারীদের চেয়েও অবৈধ পথে ইউরোপগামী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটেনের জাতীয় দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ।
পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর নাগরিকদের পাশাপাশি প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ইউরোপে অনুপ্রবেশ করছেন। পূর্ব ইউরোপের গভীর অরণ্য, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উন্নত দেশগুলোতে প্রবেশের এই যাত্রায় মারাও যাচ্ছেন তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ইউরোপে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইতালিতে প্রবেশের জন্য ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন ৩ হাজার ৩০০ জনের বেশি বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে যাত্রাপথে সাগরে ডুবে মারা গেছেন ১ হাজারের বেশি।
ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তারা বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিবছর যত মানুষ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছেন, গত প্রায় ৬ বছর ধরে তাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশি তরুণরা।
২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের সংখ্যা বিগত বছরগুলোর চেয়ে কম ছিল; তারপরও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া ও মরক্কোর তুলনায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
দ্য টেলিগ্রাফ স¤প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। তাদের অনুসন্ধানের মূল বিষয় বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম, প্রতিবছরই জিডিপি বাড়ছে। এমনকি করোনা মহামারির কারণে বিগত ২০২০-২১ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জিডিপি যেখানে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা আছে; সেখানে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ার সম্ভাবনা আছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তাহলে কেন প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
ইউরোপে বসবাস করা মানেই উন্নত জীবন, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল থাকাকে প্রতি বছর ইউরোপে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন বাংলাদেশভিত্তিক উন্নয়নসংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম হাসান। তিনি টেলিগ্রাফকে বলেন, বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, আমরা এই যুবকদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছি এটা কোনো স্বপ্নপূরণের যাত্রা নয়; বরং মৃত্যু অভিমুখে যাত্রা। কিন্তু তারা এসব কথায় কান দিতে প্রস্তুত নন।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সী আলফাই আলি হোসেন সজীব জানিয়েছেন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। দ্য টেলিগ্রাফকে তিনি বলেন নির্মাণশিল্পের কাজে যোগ দিতে ক্রোয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য এক দালালকে এককালীন ৬ হাজারেরও বেশি ইউরো (৫ লাখ ৯৭ হাজারেরও বেশি টাকা) দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেশটির রাজধানী জাগরেবে যাওয়ার পর ওই দালালচক্রের অপর সদস্যরা তাকে একটি কক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের যাত্রীদের সঙ্গে বন্দি রেখেছিল। টেলিগ্রাফকে সজীব বলেন, তারা আমাকে আরও আড়াই লাখ টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছিল। প্রতিদিন তারা আমাকে নির্যাতন করত, মারধর করত এবং খাবারও দিত অনিয়মিত।
শরিফুল হাসান বলেন, যারা কোনোভাবে ইউরোপে অনুপ্রবেশে সক্ষম হয় এবং সেখানে কাজ জোটাতে পারে, তারা দেশে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় তার পরিবারের সদস্যরা স্বচ্ছল জীবনযাপন করে, আবাসিক ভবন তৈরি করে। অধিকাংশ মানুষ এই চাকচিক্য দেখে প্রভাবিত হয়। কিন্তু বিপুলসংখ্যক অনুপ্রবেশকারী যে যাত্রাপথে মারা যায়, কিংবা সেখানে প্রবেশের পর কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে; সেসব ঘটনা এই মানুষেরা গুরুত্ব দেয় না।
প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক। টেলিগ্রাফকে তিনি বলেন, ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং তাদের (অনুপ্রবেশকারী) পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা লোকজন। তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করত, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদিও বরাবরই বলে আসছেন, দারিদ্র্যের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে এবং দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে এটি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশের হারও। বিষয়টি সমাধানে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন উল্লেখ করে শরিফুল হাসান টেলিগ্রাফকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেফতার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ- উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।