রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা ২০০৮ ধারা ৯ (খ) অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হিসাব প্রতিবছর নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধানবলেই বিধিমালায় এ বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হলো এমন বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির পেছনের যৌক্তিকতা।
দেড় বছর ধরে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এবং নির্বাচন কমিশনে একাধিকবার ব্যক্তিগতভাবে আবেদন করেও কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হিসাব পেতে আমি ব্যর্থ হই। এমনকি তথ্য কমিশনে দুই-দুবার আপিল করেও আমি সফল হতে পারিনি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায়ে নির্বাচন কমিশন ও তথ্য কমিশনের রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হিসাব আমাকে না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
রায়টি ঐতিহাসিক, কারণ এটিই তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর অধীনে, আমাদের জানা মতে, উচ্চ আদালতের প্রথম রায়। আর এই রায়ের মাধ্যমে আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি। তবে আদালতের রুল ‘অ্যাবসলিউট’ করা থেকে এরই মাধ্যমে এটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে ‘কর্তৃপক্ষ’ বা যেকোনো সরকারি দপ্তরে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেসরকারি সংস্থায় রক্ষিত যেকোনো তথ্য, তৃতীয় পক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকা সত্ত্বেও, জনগণের প্রাপ্য এবং তারা এগুলো পেতে পারেন। অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষ থেকে সংগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও এসব আইনানুযায়ী ‘তথ্য’ বা ‘পাবলিক ইনফরমেশন’ এবং এগুলো প্রাপ্তির অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা যাবে না। তথ্য অধিকার আইনে অবশ্য এসব তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যতিক্রমের কথা বলা আছে, যেমন: রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি; তৃতীয় পক্ষের বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত; কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য। বস্তুত, উপরিউক্ত ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে কোনো দপ্তরে সংরক্ষিত নথিসমূহের নোট-শিট ব্যতীত অন্য যেকোনো ধরনের তথ্যসংবলিত বস্তু বা এর প্রতিলিপি তথ্য হিসেবে গণ্য হবে।
আদালতের এ যুগান্তকারী রায়টি পাওয়ার পেছনে অবশ্য একটি দীর্ঘ দুঃখজনক ইতিহাস রয়েছে। নির্বাচন কমিশনে আইনানুযায়ী জমা দেওয়া রাজনৈতিক দলের অডিট করা আয়-ব্যয়ের হিসাব পেতে অনেক দিন থেকেই ব্যক্তিগতভাবে অনানুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি। এতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৩ সালের ১২ জুন তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর অধীনে এগুলো পেতে নির্বাচন কমিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি আবেদন করি। তিন-তিনবার কমিশনে আবেদন করেও এ তথ্য পেতে আমি ব্যর্থ হই। কমিশন যুক্তি দেয় যে এগুলো রাজনৈতিক দলের গোপনীয় হিসাব এবং এগুলো আমাদের হয় দলগুলো থেকে সরাসরি পেতে হবে অথবা কমিশনের এগুলো দিতে হলে দলগুলোর অনুমতি লাগবে। কমিশন অবশ্য লিখিতভাবে অনুমতি চেয়েও উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পায়নি।
এই দীর্ঘ সময়ে তথ্য কমিশনে দু-দুবার আপিল করেও আমি ব্যর্থ হই। তথ্য কমিশন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে একমত হয়ে আমার প্রথম আপিলটি খারিজ করে দেয়। তথ্য তথা পাবলিক ইনফরমেশন-সম্পর্কিত আইনের ব্যাখ্যা সঠিক নয় বলে দাবি করে আমি তথ্য কমিশনে আবার আপিল করি। এবারও প্রায় একই যুক্তিতে কমিশন আমার আপিল নাকচ করে দেয়।
তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা ছয়জন নাগরিক—এম হাফিজউদ্দিন খান, এএসএম শাহজাহান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. তোফায়েল আহমেদ, আলী ইমাম মজুমদার ও আমি—হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের করি। চূড়ান্ত শুনানির পর মাননীয় বিচারপতি ফারাহ্ মাহবুব ও কাজী ইজারুল হক সমন্বয়ে ঘটিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নির্বাচন ও তথ্য কমিশনের রাজনৈতিক দলের তথ্য না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি যুগান্তকারী রায় দেন। মামলাটি পরিচালনা করেন ড. শরিফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন ড. শামসুল বারী।
অনেকগুলো কারণে হাইকোর্টের দেওয়া রায়টি যুগান্তকারী। প্রথমত, এর মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ বহুলাংশে উন্মুক্ত হলো এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতির অবসান ঘটার পথ প্রশস্ত হলো। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখন থেকে যেকোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকারি দপ্তরে সংগৃহীত তথ্য—সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া—যেকোনো নাগরিক বা গণমাধ্যমের পাওয়ার পথের প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হলো। কারণ, এগুলো এখন থেকে আর গোপনীয় তথ্য নয়, বরং পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে নাগরিকের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার তার বাক্ বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথা মৌলিক অধিকার হিসেবে আবারও স্বীকৃতি পেল। কারণ, নাগরিকের মত প্রকাশের জন্য তার মত গঠন আবশ্যক, যার জন্য তথ্য অপরিহার্য। তৃতীয়ত, এ প্রগতিশীল রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা-জবাবদিহির পথ প্রশস্ত হলো।
রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম করার জন্য আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ পরিচালিত খানা জরিপে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বস্তুত রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই দেশে অনেক অন্যায়-অনিয়ম হয়ে থাকে। তাই রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এগুলোকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা আবশ্যক ও যৌক্তিক।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয় এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো এগুলো মালিকদের স্বার্থে কাজ করে না। এগুলো জনস্বার্থে কাজ করে। জনগণের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে এগুলো সংগঠিত হয়, নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে এবং নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ক্ষমতায় যায়। যেসব প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে কাজ করে, জনস্বার্থেই তাদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যক। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো তথ্য অধিকার আইনের অধীনে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণার কোনো বিকল্প নেই।
আরেকটি যুক্তিতেও রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের চাঁদা নিয়ে চলে—ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো মালিকদের অর্থে নয়—তাই জনগণের কাছে এগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা এবং তাদের জনস্বার্থে নাগরিকদের তথ্য প্রদানে কোনোরূপ বাধা থাকা অনুচিত। প্রসঙ্গত, আইনে নির্ধারিত করা না থাকলেও ভারতীয় তথ্য কমিশন ইতিমধ্যেই ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
উপরন্তু, রাজনৈতিক দল কিছু সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকে। যেমন আয়কর অধ্যাদেশের এসআরও-২০১১ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলকে আয়কর প্রদান করতে হয় না। যে প্রতিষ্ঠানে সরকারি তথা জনগণের অর্থ ব্যয় হয়, সেই প্রতিষ্ঠানকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হতে হয়। আর জনগণের কাছে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা তাদের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
সর্বোপরি আমাদের সংবিধান জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের মুখবন্ধ অনুযায়ী জনগণকে তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করাই এই আইনের উদ্দেশ্য। আর ভোটার হিসেবে এ ক্ষমতায়নের জন্যই রাজনৈতিক দল-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জনগণকে দেওয়া আবশ্যক, যা সম্ভব রাজনৈতিক দলকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমেই। তাই আশা করি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে অদূর ভবিষ্যতে জনস্বার্থে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা হবে।