সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪০ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম:
ঢাকা থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের নিয়ে এ কে ট্রাভেলসের একটি বাস চুয়াডাঙ্গার দিকে রওয়ানা হয় ৫ জুন ঈদের দিন। বাসটি ফরিদপুর সদর উপজেলায় গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে ৪ জনসহ ৬ জন নিহত ও অন্তত ১৫ জন আহত হয়। বেপরোয়া গতির কারণে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এমন একটি দুটি নয়, শুধু ঈদের দিনই সড়কে অন্তত ২১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ঈদযাত্রার ১৩ দিনে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। পঙ্গু হয়েছেন আরও অনেকে। এদিকে, যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ঈদযাত্রায় ২৫৬টি দুর্ঘটনায় ২৯৮ জন নিহত ও ৮৬০ জন আহত হয়েছেন।
সড়ক সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বেপরোয়া গতি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক-হেলপার দ্বারা গাড়ি চালানো, বিশ্রামহীন গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া ওভারটেকিং, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে অটোরিকশা; নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার নিষিদ্ধ যান চলাচল, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, চালককে আগে যেতে তাড়া দেয়া, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতা বিভিন্ন বিষয়কে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিগত বছরের চেয়ে এবার সড়কের অবস্থা তুলনামূলক ভালো থাকায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা কিছুটা কম ছিল। এবছর মহাসড়কের তুলনায় আঞ্চলিক সড়কগুলোতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদের মতে, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ, ঈদযাত্রার আগে পরে পর্যাপ্ত ছুটি রাখা, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা এবং জনসাধারণকে সচেতন করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৯’ প্রকাশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির তথ্যমতে, পবিত্র ঈদুল ফিতরে যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৩২টি দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত ও ৮৪৯ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৫৬টি। যাতে ২৯৮ জন নিহত ও ৮৬০ জন আহত হয়েছেন। দেশের ৪০টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, ৮টি অনলাইন সংবাদ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সংগঠনটি দুর্ঘটানারোধে ১০ দফা সুপারিশ করে।
লিখিত বক্তব্যে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত বছরের তুলনায় এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, নিহত ২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও আহত ৪৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমেছে। এ বছর মোট ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনার ৭৬টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। এ সংখ্যা মোট নিহত যাত্রীর ৩০ শতাংশ এবং মোট আহত যাত্রীর ১০ শতাংশ। অন্যদিকে পথচারীকে গাড়িচাপা দেয়ার ঘটনা ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। আগামী ঈদে এ দুটি ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো তথা প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
সমিতির তথ্যমতে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৩০ মে থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১১ জুন পর্যন্ত ১৩ দিনে ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন নিহত ও ৮৪৯ জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে ৪০ জন চালক, ২০ জন শ্রমিক, ৬৮ জন নারী, ৩৩ শিশু, ২৪ ছাত্রছাত্রী, ২ জন চিকিৎসক, ১৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৩ জন রাজনৈতিক নেতা ও ৯১২ জন পথচারী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
উল্লিখিত সময়ে রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৮টি, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২টি , ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন সংঘর্ষে ১টি, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার ২টি ঘটনায় মোট ১৩ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে নৌপথে ১১টি ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত, ৩ জন নিখোঁজ ও ৮ জন আহত হয়েছেন।
সংগঠিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বাস, ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ মোটরসাইকেল ২৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, লরি, ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ কার-মাইক্রো, ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ অটোরিকশা, ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। এসব দুর্ঘটনার ২৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪৪ দশমিক ৮২ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেয়া, ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ও ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে সংঘটিত হয়েছে।
সংগঠনটির ভাষ্য, বিগত ঈদের চেয়ে এবার রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো ছিল, নৌপথে বেশ কয়েকটি নতুন লঞ্চ বহরে যুক্ত হয়েছে, রেলপথেও বেশ কয়েক জোড়া নতুন রেল ও বগি সংযুক্ত হয়েছে। এছাড়া এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় জনসাধারণ আগেভাগে বাড়ি পাঠানোর সুযোগ কাজে লাগানোর কারণে ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হয়েছে।
এদিকে, কয়েকদিন আগে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ তাদের প্রতিবেদনে ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে ১২ দিনে ২১২টি দুর্ঘটনায় ২৪৭ জন নিহত ও ৬৬৪ জন হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে। সংগঠনের সভাপতি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) জি এম কামরুল ইসলাম বলেন, ১২ দিনে সড়ক ও মহাসড়কে ১৮৫টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২২১ জনের। আহত হয়েছে আরও ২৪৭ জন। এছাড়া নৌপথে ৫টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে চারজনের ও আহত হয়েছে আরও ১২ জন। একইসময়ে রেলপথে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এছাড়া নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি জানায়, এবারের ঈদযাত্রায় ৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪২ নিহত ও ৩২৪ জন আহত হয়েছেন। সংস্থাটির মতে, সড়ক-মহাসড়ক ও নৌপথের অবস্থা তুলনামূলক কম যানজট থাকলেও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ে যাত্রীরা প্রত্যাশিত সেবা পাননি। তারা ফেরিঘাট ও টোল প্লাজায় ব্যয় হওয়া সময় পুষিয়ে নিতে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ট্রাফিক পুলিশের উদাসীনতা, নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীদের তাগিদ দেয়াকে দুর্ঘটনার অতিরিক্ত কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন।
এর বাইরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এবার ঈদযাত্রার ১৪ দিনে সংঘটিত ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ১৯৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে। সংস্থাটির তথ্যমতে, সংঘটিত ১৪৮টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৯২টি ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে। এছাড়া মহাসড়কে ঘটেছে ৫৬টি দুর্ঘটনা। সংস্থাটির ভাষ্য, এবার দীর্ঘ ছুটির কারণে সড়কপথের ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক ছিল। তবে ট্রেনে বহু যাত্রী চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে যাত্রীকল্যাণ সমিরিত ১০ দফা সুপারিশ হলো- প্রথম: চালকের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স ইস্যু পদ্ধতি আধুনিকায়ন, যানবাহনের ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি আধুনিকায়ন, রাস্তায় ফুটপাথ-আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ, জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও গবেষণা, ডিজিটাল ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ সড়ক নিরাপত্তায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য চলতি বাজেটে সড়ক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া। দ্বিতীয়: জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। তৃতীয়: চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা। চতুর্থ: ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা। পঞ্চম: ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা। ৬ষ্ঠ: মহাসড়কে গতি নিরাপদ করা, ধীরগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা। সপ্তম: মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রা নিষিদ্ধ করা। অষ্টম: ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধের আদেশ শতভাগ কার্যকর করা। নবম: সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে যেসব সুপারিশ প্রণীত হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা এবং দশম সুপারিশ হলো ঈদের আগে ও পরের ৩ দিন ঈদের ছুটি নিশ্চিত করা।
সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব