শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৩ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
২০১৭ সালের চৈত্রের মাঝামাঝিতে অতিবৃষ্টির ফলে সুনামগঞ্জের সবকটি হাওর প্লাবিত হয়। হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ও ডুবে গিয়ে পুরো জেলার ধান পাকার আগেই তলিয়ে যায়, ফলে কৃষকরা গোলায় ধান উঠাতে পারেনি। এরপর থেকেই হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পদ্ধতির পরিবর্তন করে সরকার। আগের চেয়ে বরাদ্দও বাড়িয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে হাওর রক্ষা বাঁধে আর্থিক অনিয়ম কম ও কাজের মান কিছুটা ভালো হলেও এ বছর জেলার দিরাই উপজেলার সবকটি বাঁধেই নিম্নমানের কাজ হচ্ছে। পাশাপাশি অদক্ষ ও নতুন লোকদেরকে পিআইসির সভাপতি বানিয়ে কাজ করায় যেমনি কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি সীমাহীন দুর্নীতিও চলছে। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উপজেলার হাওরগুলোর মধ্যে যে কয়টি বাঁধ গুরুত্বপূর্ণ, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উদগল হাওরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি। কিন্তু এ বাঁধগুলোতেই কাজের মান একেবারেই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কোন ধরণের নিয়ম-নীতি মানছেন না সংশ্লিষ্ট পিআইসির সভাপতিরা। কোথাও গত বছরের বাঁধের উপর মাটি ফেলে বাঁধ নির্মাণ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের পায়তারা চলছে। কোথাও প্রকল্প স্থানে সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে চলে এলেও রেজিস্ট্রার পড়ে আছে অফিসেই।
৫নং পিআইসির সভাপতি দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের ধনপুর গ্রামের আকরাম আলীর ছেলে ফারুক মিয়া। তিনি উদগল হাওরের উপ-প্রকল্পের তিনটি অংশের মোট ০.১৬০ কিলোমিটার বাঁধের ভাঙ্গা বন্ধকরণ ও মেরামত কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩১ টাকা ৩৯ পয়সা। সরেজমিন দেখা যায়, দিরাই-শাল্লা রোড থেকে ধনপুর গ্রামের সাথে যুক্ত এ বাঁধের অংশটির উভয়পার্শ্বেই পুকুর রয়েছে। তাছাড়া তিনি বালি মাটি দিয়ে বাঁধের কাজ করছেন। ঠিকমতো ড্রেসিং, দুর্মুজ ও ঘাস লাগানো হয়নি। বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি স্বীকার করেন যে, হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে আগে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই, তবে তিনি চেষ্টা করতেছেন ভালো কাজ করতে।
৬নং পিআইসির সভাপতি একই ইউনিয়নের ধনপুর (খাড়ারপাড়) গ্রামের জহুর আলীর ছেলে মস্তফা মিয়া। তিনি উদগল হাওরের উপ-প্রকল্পের ০.২৯৯ কিলোমিটার বাঁধের ভাঙ্গা বন্ধকরণ ও মেরামতের কাজ করছেন। প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৩৩৩ টাকা। তার দাবী, ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অথচ দেখা গেছে, তখন পর্যন্ত মাটি কাটার কাজও শেষ হয়নি, ড্রেসিং ও দুর্মুজ ঠিকমতো হয়নি এবং ঘাস লাগানোও বাকি রয়েছে। তাছাড়া নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে বাঁধের পাশ থেকেই মাটি তোলা হচ্ছে।
৩৯নং পিআইসির সভাপতি উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের তলবাউসি গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নাছের ছেলে কাচা মিয়া। তার প্রকল্প হচ্ছে উদগল হাওরের উপ-প্রকল্পের ০.২১২ কিলোমিটার বাঁধের ভাঙ্গা বন্ধকরণ ও মেরামতের কাজ। প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮৭ টাকা ৮৯ পয়সা। সরেজমিন দেখা যায়, প্রকল্পের মাত্র ৪০ হাত বাঁধে মাটি নেই। তাছাড়া বাকি অংশের পুরোটাই গত বছরের বাঁধের মাটি অক্ষত রয়েছে, কিন্তু তার উপরও মাটি ফেলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তার সাথে মোবাইলে কথা বললে তিনি বাড়িতে থাকার পরও বাজারে আছেন বলে জানান। সাথে সাথে বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়। তার দাবী, বাঁধের কাজ নিয়ম মতো হচ্ছে, এ পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, মাটি কাটা চলছে, ড্রেসিং বা দুর্মুজ কিংবা ঘাস লাগানো হয়নি।
৩৭নং পিআইসির সভাপতি উপজেলার দিরাই পৌরসভার ঘাগটিয়া গ্রামের মৃত তাহির উল্লাহর ছেলে আব্দুল মমিন মিয়া। তার প্রকল্প হচ্ছে উদগল হাওরের উপ-প্রকল্পের ০.০৬১ কিলোমিটার বাঁধের ভাঙ্গা বন্ধকরণ ও মেরামতের কাজ। প্রকল্পের বরাদ্দ হচ্ছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৯৮ টাকা ৯৪ পয়সা। প্রকল্পের স্থানে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো না থাকায় মোবাইলে কথা বলার পর তিনি বাড়ি থেকে সাইনবোর্ড নিয়ে আসেন। প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, চোরের ভয়ে সাইনবোর্ড বাড়িতে রাখেন, তার রেজিস্ট্রার বইটিও অফিসে রয়েছে।
তবে প্রত্যেক পিআইসি কমিটির সভাপতিদের দাবী, এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট অফিসের লোকজন কাজ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দিরাইয়ের উপ-সহকারি প্রকৌশলী (শাখা কর্মকর্তা) রিপন আলী জানান, এ পর্যন্ত সবকিছু মিলে ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প স্থানে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রাখা, বালি, কাদা ও কালো মাটি দিয়ে বাঁধ না বাধার নিয়ম রয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক পিআইসি সভাপতির কাছে রেজিস্ট্রার থাকার কথা। কাজের মান নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, কোন বাঁধে যদি অনিয়ম করে, আমরা তাদেরকে ছাড় দিবো না।