শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২০ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর রহ. ছিলেন আলেম সমাজের অভিভাবক

শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর রহ. ছিলেন আলেম সমাজের অভিভাবক

amarsurma.com
শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর রহ. ছিলেন আলেম সমাজের অভিভাবক

. সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ:
দেশের প্রথিতযশা আলেম ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ হযরত শাহজালাল রহ. সিলেট’র মুহতামিম, শায়খুল হাদিস মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। গতকাল ১৭ মে বুধবার বাদ মাগরিব তিনি দরগাহ মাদরাসায় তাঁর নিজ বিশ্রামাগারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি গাছবাড়ি হুজুর নামে পরিচিত ছিলেন। মরহুমের জানাজার নামাজ আজ ১৮ মে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় (২.৩০) ঐতিহাসিক সিলেট শাহী ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।
মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর রহ. সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের উত্তর-পূ্র্ব সীমান্তে ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট উপজেলার ৮নং ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের গোয়ালজুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৫ খ্রি. বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক রহ.।
শিক্ষা জীবন : মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর রহ. এর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় তাঁর বাবা মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক রহ. এর কাছে এবং নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে মাজাহিরুল উলূম আকুনি মাদরাসায় সানাবিয়া ৩য় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ খ্রি. তিনি ভর্তি হন কানাইঘাটের বিখ্যাত দারুল উলূম কানাইঘাট মাদরাসায় এবং উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা মুশাহিদ বায়েমপুরী রহ.-এর শিষ্যত্ব লাভ করেন। এরপর ১৯৬৫ খ্রি. তিনি ঢাকাউত্তর রানাপিং জামেয়া আরবিয়া হোসাইনিয়া মাদাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনিই যুগশ্রেষ্ট আলেম শায়খুল হাদিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা রিয়াছত আলী চৌঘরি রহ.-এর সুহবত লাভ করেন। এখানে ছয় মাস লেখাপড়া করে তিনি চলে যান দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদাসায়। সেখানে তিনি ৪ বছর লেখাপড়া করে উলূমে আরাবিয়ার বিভিন্ন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করার পাশাপাশি ১৯৬৭ খ্রি. তাকমিল ফিল হাদিস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পাশাপাশি তিনি হাটহাজার মাদরাসায় ফেক্বাহ, তাফসীর, আদব ও মানতিক বিষয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র।
কর্ম জীবন : গাছবাড়ী হুজুরের কর্ম জীবন ১৯৬৯ খ্রি. শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর অন্যতম খলীফা মদফুওনে মক্কী মাওলানা আব্দুল হক শায়খে গাজীনগরী রহ.-এর হাতে গড়া ইসলামি মারকাজ সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম হুসাইনিয়া দরগাহপুর মাদরাসায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। ১৯৬৯ খ্রি. থেকে ১৯৭২ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ বছর অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তিনি হাদিস শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাবাদির পড়ান। পরবর্তীতে জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হযরত শাহজালাল রহ. সিলেট-এর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামীম ও দরগাহে হযরত শাহজালাল রহ. মসজিদের ইমাম ও খতিব সিলেটের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবর আরিফ বিল্লাহ হাফিজ মাওলানা আকবর আলী রহ.-এর আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৭৩ খ্রি. দরগাহ মাদরাসায় যোগদান করেন। এরপর থেকে এখানেই তিনি দীর্ঘ ৪৮ বছর পর্যায়ক্রমে সাধারণ শিক্ষক, সদরে মুদাররিস, শিক্ষাসচিব, শায়খুল হাদিস এবং ২০১৯ খ্রি. মাদরাসার মুহতামীম মুফতি মাওলানা আবুল কালাম জাকারিয়া রহ.-এর ইন্তেকালের পর তিনি মাদরাসার মুহতামীমের দায়িত্ব লাভ করেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
গাছবাড়ী হুজুর রহ. দরগাহ মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ এর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি আযাদ দ্বীনী এদারার সিনিয়র সহসভাপতি এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। এছাড়া তিনি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আল হাইআতুল ‘উলইয়ার লিল মাদরাসাতিল কাওমিয়্যাহ এর সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় পরীক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য। তাছাড়া তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সিলেট জেলার সভাপতি, সিলেট জেলা উলামা কমিটির চেয়ারম্যান, খাদিমুল কুরআন পরিষদের সভাপতি, সিলেট জেলা ফতোয়াবোর্ডের চেয়ারম্যান। এছাড়া সিলেট বিভাগের অসংখ্য মাদরাসার মজলিসে শূরার সভাপতি বা সম্মানীত সদস্য।
হুজুর রহ. ছিলেন আমার উস্তাদ : দরগাহ মাদরাসায় ১৯৯২খ্রি. আমি মিশকাত জামাতে ভর্তি হওয়ার সুবাদে হুজুরের সাথে পরিচয়। মেঝ ভাই মুফতি সৈয়দ নুমান আহমদ ছিলেন হুজুরের মায়ার একজন ছাত্র। তিনি একবছর দরগাহ মাদরাসায় লেখা পড়া করেছিলেন৷ আমি সৈয়দপুর দারুল হাদীস মাদরাসায় মিশকাত জামাতের বছর আলীয়া মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দেই। মাদরাসার পূরাতন সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে আলীয়া থেকে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণকারীদের সুযোগ না থাকার সুবাদে আমাকে ভর্তি করতে সিলেট নিয়ে আসেন মেঝ ভাই মুফতি নুমান৷ তিনি তখন সৈয়দপুর দারুল হাদীস মাদরাসার সিনিয়র উস্তাদ। দরগাহ মাদরাসায় এসে প্রথমে গাছবাড়ী হুজুরের সাথে দেখা করতে প্রবেশ করলে ‘মুফতি নুমান নিবা’ বলে সম্ভোধন করে আমাদের বসতে বলেন। সাথে আমাকে দেখে ‘ই খে’ বা তোমার ভাইনি, তোমার লাখান লাগের’ বললে আমি আমার নাম এবং দরগাহ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে পড়তে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। আমার কথা শুনে হুজুর বললেন ‘তোমরা সৈদপুরী বডিংও খাইয়া তাখতায় পারতায় নায় বা’ আমি বললাল হুজুরের দোয়া থাকলে ইনশাল্লাহ পারবো। তিনি বললেন ‘মাথানো মুণ্ডাইতায় অইবায় আর সৈয়দতোবা বডিংএ টাখা দিয়া খাইতায় অইবায়নো।’ উত্তরে- জি ইনশাআল্লাহ হুজুর।ভর্তির ব্যবস্থা হলো। হুজুর তখন ছিলেন মাদরাসার শিক্ষা সচিব। দুই বছর (মিশকাত ও দাওরা) দরগাহ মাদরাসায় লেখা-পড়া করে কওমী ধারার শিক্ষা সমাপন করি। হুজুর আমাকে খুবই শ্নেহ করতেন। সুন্দর সহজ সিলেটি মায়াবি ভাষায় হুজুর রহ. কথা বলতেন ।
গাছবাড়ী হুজুর রহ. কোন প্রথাগত আলেম ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও প্রাজ্ঞ শিক্ষাবীদ। আমাদের জাতীয় ও সমাজজীবনে তার রয়েছে বহুমুখী অবদান। তিনি ছিলেন এ দেশের অন্যতম এককন শায়খুল হাদীস, একজন বিচক্ষণ আলেমে দ্বীন, কওমী অঙ্গনের ভরষাস্থল। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত না থাকলেও সকল ইসলামি দলের মধ্যে তাঁর এলটা গ্রহনযোগ্যতা ছিল। হুজুরের যে কোন ডাকে সাড়া দল-মত নির্বিশেষে সাড়া দিতেন সিলেট বিভাগের মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক ও আম জনতা। ইসলাম, দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ অবদান। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ইসলামের সঠিক কথা মুসল্লিদের সামনে তুলে ধরতেন। তিনি ছিলেন সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। দলমত নির্বিশেষে সকলের সাথে তাঁর ছিল গভীর দ্বীনি সম্পর্ক। তাঁর ইন্তেকালে দেশ একজন শীর্ষ আলিমে দ্বীনকে হারালো।

লেখক: প্রিন্সিপাল, সৈয়দপুর সৈয়দিয়া শামছিয়া ফাযিল মাদরাসা

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com