সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪২ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার : এক সময়ের দুই প্রভাবশালী বামপন্থী নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামীলীগে আসার পর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল৷ সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর তারই অনুসারীরা এই দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেছেন৷
দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর হঠাৎ করেই সক্রিয় হচ্ছে পুরাতন একটি দ্বন্দ্ব, আর তা হলো সামাদ-সুরঞ্জিত গ্র“প। তবে এবার সরাসরি সামাদ-সুরঞ্জিত নয়, মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদের একান্ত ঘনিষ্ট ও আস্তাভাজন হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মতিউর রহমান কেন্দ্রীক। দলের একাধিক সূত্র জানানয়, ৫ম ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই মূলত এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। তারা জানান, আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, দিরাই-শাল্লার এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান দিরাই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিয়েই দুই নেতার সমর্থকরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে আছেন।
সূত্র মতে, দিরাই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজের পছন্দের প্রার্থীদের একটি তালিকা জমা দেন আওয়ামীলীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে। অপরদিকে জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতিও পৃথক একটি তালিকা জমা দেন, কিন্তু সর্বশেষ ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টিতে সুরঞ্জিত ও ২টিতে মতিউর রহমানের মনোনীতদের প্রার্থী করা হলেও তা মেনে নিতে পারেন নি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমর্থকরা। তারা মতিউর রহমানের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দেয় উপজেলার ভাটিপাড়া ও জগদল ইউনিয়নে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয় থেকে মিছিল সহকারে দলীয় নেতাকর্মীরা মনোনয়নপত্র জমা দিলেও ভাটিপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও জগদল ইউনিয়নে হুমায়ূন রশিদ লাভলুকে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভাটিপাড়ায় শাহজাহান কাজী ও জগদল ইউনিয়নে শিবলী আহমদ বেগকে মনোনয়ন দেয় স্থানীয় আওয়ামীলীগ।
দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আছাব উদ্দিন সরদার, সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দিরাই পৌরসভার মেয়র মোঃ মোশারফ মিয়া নেতৃত্বে মিছিল সহকারে বিদ্রোহীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় দলে সমালোচনা দেখা দেয়। সভাপতির বিরুদ্ধে কমিরপুর ইউনিয়নে বিদ্রোহীপ্রার্থী হন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি শাহজাহান সরদার।
উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মনোনীত নৌকার প্রার্থী রয়েছেন সৌম্য চৌধুরী (সমু)। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জুয়েল। হঠাৎ করে রাজানগর ইউনিয়নে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমানের সফরকে ভালো চোখে দেখছেন না সুরঞ্জিত সমর্থকরা। মতিউর রহমানের সাথে দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের বিরাট একটি অংশ প্রকাশ্যে সুরঞ্জিত সমর্থকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ইতোমধ্যে দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি আলতাব উদ্দিনের সাথে মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চলছে।
বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আছাব উদ্দিন সরদার। তিনি নিজে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জগদল ও ভাটিপাড়া ইউনিয়নে নৌকার বিরোধিতা করায় নাকোশ নেতাকর্মীরা। করিমপুর ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আনারসের পক্ষে কাজ করছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু আনারসের পক্ষেই ভোট চাইছেন না; আছাব উদ্দিন সরদার যে ইউনিয়নে নৌকার বিরোধিতা করছেন, সে ইউনিয়নে তারা নৌকার পক্ষে কাজ করছেন।
এদিকে গত ২১মে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মতিউর রহমান নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে দিরাই উপজেলায় তার মনোনীত জগদল ও ভাটিপাড়া ইউনিয়নের গণসংযোগ করায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে খোদ আওয়ামীলীগের একটি অংশও তার ওপর বেজায় নাখোশ বলে জানা গেছে। তারা এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলে একথা পরিষ্কার যে, তিনি যদি সত্যিই শেখ হাসিনা তথা নৌকার পক্ষের সমর্থনে ভোট চাইতে আসেন, তবে কেন শুধুমাত্র তার পসন্দের প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ করলেন; সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতিও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন; জেলা সভাপতি হিসেবে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার পক্ষে ভোট চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু তিনি সেখানে না যাওয়াতে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের সন্দেহ থেকেই গেল।
সূত্র আরো জানায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যারা নৌকার বিরোধিতা করেছেন, তাদেরকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমান। ইতোমধ্যেই দিরাই উপজেলার ৭নং জগদল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা শিবলী আহমদ বেগকে দলের সকল পর্যায় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন তিনি। এ ঘটনার পর থেকেই বহিষ্কার আতংকে রয়েছেন অনেকেই।
অপরদিকে উপজেলা আওয়ামীলীগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার খেলা শুরু হবে, আর এর মধ্য দিয়েই পুনরায় সক্রিয় হবে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা সামাদ বলয় ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলয়ের দ্বন্দ্ব। এ নিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি বড় ধরণের সংঘর্ষের আশঙ্কাও করছেন অনেকেই।