প্রবাসী বাংলাদেশি কিংবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সফল ব্যক্তিরা সবসময়ই অনুকরণীয় এবং অনুপ্রেরণীয় আদর্শ। ব্রিটেনের অন্যতম ধনী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইকবাল আহমেদ ওবিই তেমনই একজন। বিশ্বখ্যাত সি মার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নিজস্ব মেধা আর চেষ্টায় তার ব্যবসাকে করেন সম্প্রসারিত। উঠে এসেছেন ব্রিটেনের প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তিদের তালিকায়। তাকে নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন- রণক ইকরাম
শুরুর গল্প : বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান অধিকাংশ মানুষের শুরুর গল্পটা নেহায়েতই সাদামাটা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেধা-মনন আর অভিনবত্বে কিছু কিছু গল্পের শুরুটাও নান্দনিক হয়। সে তুলনায় ইকবাল আহমেদের শুরুটাকে সাধারণই বলা চলে। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে সিলেটের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। গল্পের মূল শুরুটা ইকবালের বাবার হাত ধরে। ইকবাল তখন কেবল এসএসসির গণ্ডি পার হচ্ছেন। পরীক্ষার পর সিলেট শহর চষে বেড়ানোটাই ছিল কাজ। বাউন্ডেলেপনার সঙ্গী তার বড় দুই ভাই কামাল আর বেলাল। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চারদিক অগোছালো হয়ে পড়ে। তিন ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান বাবা। সমাধান অবশ্য কঠিন ছিল না। ইংল্যান্ডে তাদের অনেক আত্দীয়স্বজন থাকতেন। ফলে ইকবালের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে থাকবেন না। এক রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে চেপে বসেন ইংল্যান্ডগামী একটি জাহাজে। কয়েকদিনের মধ্যে তারা ইংল্যান্ডে পৌঁছে যান। ব্যাপারটা কিন্তু এতটা সহজ ছিল না। ইকবালের বাবার সাহসী সিদ্ধান্তই সেদিন তাদের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন, ইকবালের বাবার পকেটে তখন মাত্র ২০ পাউন্ডের একটি নোট। আর সেটি দিয়েই নতুন জীবন শুরু করলেন ইকবালের বাবা। এই ২০ পাউন্ড দিয়েই ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। ইকবালকে ভর্তি করিয়ে দিলেন লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার সিটি কলেজে। এখান থেকেই ইকবাল শেষ করেন উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা। এর মধ্যেই ইকবালের দুই ভাই একটি দোকানে কাজ করতেন। একসময় তিনজন মিলে বেশকিছু টাকা জমিয়ে ফেলেন। সেখান থেকেই শুরু আসল গল্প।
ইকবাল অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে সি মার্ক : ১৯৭৬ সালে ম্যানচেস্টারে বাবার ব্যবসায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিজনেস ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করেন তিনি। সঙ্গে অবশ্য তার অন্য দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বেলাল আহমেদও এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। তিন ভাইয়ের অংশগ্রহণে ব্যবসার পরিধি কেবল বাড়তেই থাকল। শুরুর দিকে তারা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করতেন। শুরু থেকেই তাদের আমদানিকৃত পণ্যগুলো ইংল্যান্ডের বাজারে ভালো গ্রহণযোগ্যতা পেল। এ আমদানির ধারাবাহিকতায় ইকবাল আহমেদ বাংলাদেশের সব ধরনের মিঠা ও লোনা পানির হিমায়িত মাছ, ব্ল্যাক টাইগার (বাগদা চিংড়ি), ফ্রেশ ওয়াটার (গলদা চিংড়ি) যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আমদানি শুরু করেন। আর তিনিই ইতিহাসের প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ ধরনের পণ্যের বিদেশি দুয়ার খুলে দেন। সে কারণে তাকে বলা হয় ইমপোর্ট ব্যবসার পথপ্রদর্শক। তিনি ফ্রোজেন ফিশ এবং সি ফুড আমদানি করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ইকবাল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি’। তার প্রতিষ্ঠান দ্রুত হিমায়িত মাছ এবং চিংড়ি আমদানিতে ইউরোপে জাতীয়ভাবে প্রথম সারির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাম কুড়িয়ে নেয়। চিংড়ি বিশেষ করে ব্ল্যাক টাইগার এবং ফ্রেশ ওয়াটার প্রাউন প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং গুদামজাতকরণে বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করে ইকবাল আহমেদের নামকরা প্রতিষ্ঠান ‘সি মার্ক’।
উত্থান পর্ব : স্বল্প সময়েই সি মার্ক পিএলসি হিমায়িত মৎস্য ও চিংড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এসব পণ্য সরবরাহের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এভাবেই বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য ও সামুদ্রিক মাছ বিদেশের বাজার দখলের সুযোগ পায় এবং বাংলাদেশও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সন্ধান লাভ করে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আর বাগদা চিংড়ি আমদানি করতে করতে চিংড়ি-সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও রেস্টুরেন্ট দাঁড় করিয়ে ফেলেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন মোড়কজাত চিংড়ি রপ্তানি। তারই চেষ্টায় সেই ২০ পাউন্ড পুঁজির ব্যবসা ২০০৮ সালে ঠেকে ১২ কোটি ইউরোতে।
ফ্যাক্টরির পর ফ্যাক্টরি : আস্তে আস্তে ব্যবসা অনেক দূর এগিয়ে যায় সি মার্ক-এর। ব্রিটিশ ইনভেস্টর হিসেবে ডিটিআই-এর উৎসাহে ১০ মিলিয়ন ইউএসডি ডলার ব্যয় করে বাংলাদেশে অতি আধুনিক ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন ইকবাল আহমেদ। ২০০০ সালের নভেম্বরে ফ্যাক্টরির প্রাতিষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আর সবার সঙ্গে আমন্ত্রিত হন রয়েল প্রিন্সেসও। অনেক সম্মানিত অতিথি সেদিন উপস্থিত ছিলেন। পরিপূর্ণ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চট্টগামের ফ্যাক্টরি আশপাশের এলাকায় খুব দ্রুত প্রসারিত হয়। সঠিক মূল্যে খাদ্যদ্রব্য হিসেবে সোমোসা’স, পারাথা এবং সবজি সরবরাহ করে আসছে। এদিকে আরও দুটি সমুদ্র খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করে একই গ্রুপ। এ গ্রুপের রয়েছে নিজস্ব নৌকা, ট্রলার এবং ফ্রিজিং সুবিধা। আরও রয়েছে নিজস্ব হ্যাচারি যেখানে উচ্চমানসম্পন্ন চিংড়ি উৎপাদন করে সারাবিশ্বে রপ্তানি করা হয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেন ইকবাল আহমেদের গ্রুপ এবং নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে কোল্ডস্টোর প্রতিষ্ঠা করে কানাডাসহ সমগ্র উত্তর আমেরিকায় পণ্য বণ্টনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন তিনি।
২০০৫ সালে ইস্ট ম্যানচেস্টারের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬.২৫ একর জায়গার ওপর একটি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে সি মার্ক। উন্নতির ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে নভেম্বরের শেষ দিকে ভার্মিলন নামে একটি থাই রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এ রেস্টুরেন্টটি সাজিয়ে তোলা হয় অসাধারণভাবে। এর দ্বিতীয় তলায় ২০০ মানুষের খাবারের জায়গা এবং ৩০০ আসনবিশিষ্ট বার স্থাপন করা হয় এবং তৃতীয় তলায় রয়েছে ১০০ আসনবিশিষ্ট অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল হলরুম। তিনটি সেক্টরে যে কোনো বিবাহ, বিজনেস কনফারেন্সের সুব্যবস্থা রয়েছে। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে বড় বড় অফিস রুম এবং বিশাল কোল্ডস্টোর। যেখানে ১২ হাজার ৫০০ টন হিমায়িত খাবার সংরক্ষণ করা যায়। একই সঙ্গে ইকবাল ব্রাদার্সের তত্ত্বাবধানে একটি আধুনিক মানসম্পন্ন হোলসেল ক্যাশ এবং কারি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে সি মার্ক।
ব্যক্তিগত জীবন : সিলেট থেকে ব্রিটেনে পাড়ি জমানোর পর তার বাকি জীবনটা ব্রিটেনময়। তবে শেকড়ের টান ভুলেননি বলেই ব্যবসায়িক সূত্রটা গাঁথা এই বাংলাদেশের সঙ্গেই। ইকবাল আহমেদ তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে মঞ্জুর আহমেদ যোগ দিয়েছেন বাবার রেস্টুরেন্ট ভারমিলিয়নে। পেশাগত জীবনের বাইরে খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করেন না ইকবাল আহমেদ। সবসময় ব্যক্তিগত জীবনটাকে রাখতে চেয়েছেন হিসাবের বাইরে। তার প্রিয় খেলা গলফ, টেনিস। অবসরে প্রায়ই গলফ খেলেন। এ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ করতে আর সময় কাটাতে ভালোবাসেন। এর বাইরে সময়-সুযোগ পেলে সাঁতার কাটেন।
সমৃদ্ধি অর্জন : খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাত এবং প্যাকিং করে ইউরোপের অধিকাংশ দেশে রপ্তানি হতো। ফলে ১৯৯৮ সালে রপ্তানিতে লোভনীয় পুরস্কার কুইন্স অ্যাওয়ার্ড লাভ করে সি মার্ক। ১৯৯৯ সালে ইউরোপের ব্যবসা জগতের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস পুরস্কার লাভ করে সি মার্ক। এ ছাড়া সি মার্ক বাংলাদেশে জাতীয় পুরস্কার এবং গোল্ড মেডেল পায়। শুধু তাই নয়, পরপর ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালে সমুদ্র খাবার রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। ইকবাল আহমেদ ২০১২ সালে জিতে নেন ‘আন্তর্জাতিক সেরা ব্যবসায়ী-২০১২ পুরস্কার। প্রতিবছর প্রায় ৫০টি দেশের ১৪০টি শহরের ছয় হাজার ৫০০ ব্যবসায়ী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ১৯৯৯ সালে লাভ করেছেন এশিয়ান বিজনেস অ্যাওয়ার্ড। ২০০১ সালে ইকবাল আহমেদকে উপাধি দেওয়া হয় ওবিই (অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার)। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মানজনক জাতীয় রপ্তানি ট্রফি (গোল্ড) অর্জন করেন। পরপর তিন বছর ইংল্যান্ডের সেরা ব্যবসায়ী পুরস্কার লাভ করেছেন এই ব্যবসায়ী। এ ছাড়া গত বছর ইকবাল আহমেদ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য ম্যানচেস্টার শহর থেকে ‘লিজেন্ডস অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন তিনি।
শীর্ষ ধনীর তালিকায় : ব্রিটেনভিত্তিক প্রভাবশালী সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইকবাল আহমেদ ব্রিটেনের এক হাজার ধনীর তালিকায় ৪৬৬তম স্থান পেয়েছেন। গত এক বছরে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২০ মিলিয়ন পাউন্ড বেড়ে হয়েছে ২০৫ মিলিয়ন পাউন্ড। ইকবাল আহমেদ ওবিই ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী সানডে টাইমসের তালিকায় ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি হিসেবে উঠে আসেন। ব্রিটেনের শীর্ষ ধনীর তালিকায় সে বছর ৫১১ নম্বর স্থান দখল করেন ইকবাল আহমেদ। তার সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ১১০ মিলিয়ন পাউন্ড।
এরপর ২০০৯ সালে এশিয়ার ২০ ধনীর তালিকায় উঠে আসেন সফল ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ।