আমার সুরমা ডটকম: প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৪ সেপ্টেম্বর বুধবার। এ দিন উপলক্ষে পরিবার এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সৈয়দ মহসিন আলী মৃত্যুবরণ করেন। পরিবার ও সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, ঈদের পর দিন হওয়ায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। তবে এদিন সকালে প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রীর কবরে আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। জেলা ছাত্রলীগ মন্ত্রীর বাসভবনপ্রাঙ্গণে আলোচনাসভার আয়োজন করবে। এতে আওয়ামী লগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মসজিদে দোয়া, মন্দির ও গীর্জায় প্রার্থণাসভা করা হবে। বাদ এশা পরিবারের উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া জেলা আওয়ামীলীগের উদ্যোগে ১ অক্টোবর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিত থাকার কথা। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দেশ আর দেশের মানুষকে অনেক দিয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গঠনে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রচুর কাজ করেছেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে মৌলভীবাজার পৌরসভায় পরপর ৩ বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন মহসিন আলী। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে সেইবার কোনো মন্ত্রীত্ব পাননি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আবার বিজয়ী হবার পর তাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তৃণমূলের এই নেতা সম্মানিত হন তার কাজের জন্য।
সৈয়দ মহসিন আলীর বাবার নাম শরাফ আলী। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। সৈয়দ মহসিন আলীর মায়ের নাম আছকিরুনন্নেছা খানম। মৌলভীবাজার থেকে ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতার আলীপুরে ছিলো তার বিশাল বাড়ি। আলীপুরের সেই বাড়িতে ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। সৈয়দ মহসিন আলীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি কলকাতার সেন্টজেবিয়ার্স স্কুলে জুনিয়র কেমব্রিজ ও সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। পরবর্তীকালে আবার বাংলাদেশে এসে বাংলা মাধ্যমে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। তবে আবারও তিনি কলকাতা থেকে ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। দেশমাতৃকার প্রতি তার মমত্ববোধের কারণে স্বতস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সম্মুখসমরে যুদ্ধচলাকালে গুলিবিদ্ধও হয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সিলেট বিভাগে সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কাজ করেছেন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গঠনেও। তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। মৌলভীবাজার মুহকুমার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিতে তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগ যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে জেলা আওয়ামীলীগেরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতাত্তোরকালে তিনিই একমাত্র জননেতা যিনি পৌরসভায় পর পর ৩বার বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে তাকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করে। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছেন। সেখানে এখন বহুমুখী বাস্তবসম্মত প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সমাজসেবায় অবদান রাখার জন্য তিনি ভারতের নেহেরু সাম্য সম্মাননা ও আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন সম্মাননা স্বর্ণপদক লাভ করেন।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ছিলো তার পছন্দের বিষয়। অবসরে তিনি বই পড়তে ভালবাসতেন। কবি-লেখকদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। দেশের বড় বড় সাংবাদিকদের অনেকেই ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু। তিনি এক সময় বাংলাদেশ টাইমসের প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গান তার প্রিয় একটি বিষয়। ধ্র“পদী, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের গানই তার মুখস্ত ছিলো। তার স্মৃতিতে প্রায় ৫ হাজার গানের সংগ্রহ ছিলো। সমাজকল্যাণে তার প্রিয় সংগীত ছিলো ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’। সমাজকল্যাণে তিনি এভাবেই তার নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন।
সৈয়দ মহসীন আলী স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সিলেট বিভাগ সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামীলীগের রাজনীতির পাশাপাশি মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে তিনবার নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় একই আসন থেকে আবারও সাংসদ নির্বাচিত হন। সে বছর তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন।