রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম:
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আজ পহেলা বৈশাখ; নতুন বছরের প্রথম দিন। করোনাভাইরাসের প্রকোপে টালমাটাল বিশ্বে একটি নতুন বছরের শুভ সূচনা। শুভ নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৭। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও গর্বিত ঐতিহ্যের রূপময় ছটায় বৈশাখ পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বেদনা ভুলে নব আনন্দে জাগবে গোটা জাতি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবার ঘরে বসে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে’ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হবে।
সারাবিশ্বের মানুষ যখন করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত; তখন প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতে চলছে। করোনায় লকডাউনে চৈত্রের রুদ্র দিনের পরিসমাপ্তি শেষে আজ গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে সব বয়সের মানুষ। দেশের সব বয়সী মানুষের জীবনের অন্যতম আনন্দের এবং মহিমান্বিত দিন এই পহেলা বৈশাখ। আজ শুরু হবে আগামী দিনের পথচলা। করোনাভাইরাসে ছুটি এবং বাধ্যতামূলক ঘরে থাকার নির্দেশনার মধ্যেই ঘরোয়াভাবে পালিত হবে দিনটি। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে; পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
মূলত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। তবে ষাটের দশকের শেষে থেকে রমনা বটমূলে ছায়ানট বর্ষবরণের আয়োজন করে।
দেশ স্বাধীনের পর মানুষের অসা¤প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও আসে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম শোভাযাত্রা। পরবর্তীতে সেখানে প্যাঁচা, হাতি ইত্যাদি জড়ানোর মধ্য দিয়ে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি চর্চা শুরু হয়।
মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তবতায় নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ। বর্ষবরণের উৎসব আমেজে মুখরিত হয়ে উঠে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া। গ্রীষ্মের খরতাপ উপেক্ষা করে দেশের মিলিত হয় তার সর্বজনীন এই অসা¤প্রদায়িক উৎসবে। দেশের পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকে লাখো মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসব মুখরতার বিহ্বলতা। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই কোথাও কোনো আয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘরে ঘরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
করোনার কারণে ছায়ানটের রমনা বটমূলের ভোরের আয়োজন বন্ধ। রমনাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কানেও আসবে না সুরের ঝঙ্কার। মানুষ ঘরবন্দি তবু থেমে থাকবে না উৎসব। অনলাইনে বর্ষবরণের কথা জানিয়েছেন ছায়ানটের সহ-সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। তারা জানান, বলেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির কারণে উৎসব করার চেয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। যাতে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখবেন ছায়ানট সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুন।
অন্যদিকে জনসমাগম না করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’ প্রতিপাদ্য করে বর্ষবরণের আয়োজন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। প্রতিবারই মূল প্রতিপাদ্যের ওপর একটি পোস্টার বের করা হয় অনুষদ থেকে। এবার সেই পোস্টারটি ভার্চুয়ালি প্রকাশ করা হবে। জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা পোস্টার করি। এবারও করেছি। তবে সেটা প্রতিপাদ্যের ব্যাখ্যাসহ। প্রতিবার প্রতিপাদ্যটি আমরা নানা মোটিভের মাধ্যমে তুলে ধরি। এবার সেটি হবে না বলে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ থেকে ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না’- এ লাইন নেয়া হচ্ছে।
প্রতীকীভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের পরিকল্পনা করছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শিশুপার্কের সামনে সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ দীর্ঘদিন ধরে নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন করলেও সংগঠনটির প্রধান ফকির আলমগীর জানান, এবার তারা ধারণ করে টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে বিকল্প উপায়ে অনুষ্ঠান করবেন।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি ঘরে বসেই দিবসটি পালন করবে।