মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২২ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম:
দেশজুড়ে আলোচিত পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনাস্থল রেকি করেই সিনহা খুনের বিবরণ জানলো র্যাবের তদন্ত দল। হত্যাকান্ডের ‘গোড়ার রহস্য’ জানতে গতকাল প্রধান ৩ আসামী বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান এই মামলা তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের একটি দল। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ারের নেতৃতে র্যাবের একটি দল (২১ আগষ্ট) শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার সিনহা খুনের ঘটনাস্থল টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুরে যান।
শুক্রবার দুপুরে মেজর সিনহা হত্যা মামলার আসামী টেকনাফ থানার বরখাস্ত বেপরোয়া আসামি ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলাল কে যখন সিনহা হত্যার ঘটনাস্থলে নিয়ে যায় র্যাব। তখন সেখানে শত শত মানুষ এই দৃশ্য দেখার জন্য চার পাশে জড়ো হয়। এসময় স্থানীয় লোকজনকে বলাবলি করতে শোনা গেছে সবকিছুর একটা শেষ আছে। গত ২ বছরে প্রদীপ টেকনাফে শত শত মানুষ খুন করেছে, যতগুলো নারী ধর্ষণ করেছে এবং চাঁদাবাজি ও লুটপাট করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার।
একদিন এমন দৃশ্য দেখার জন্য তারা অপেক্ষা করেছিলেন বলেও অনেককে বলাবলি করতে শুনা গেছে। এভাবে হাত কড়াপরা প্রদীপকে নিজের কৃত অপকর্মের জবাবদিহি করতে হবে কোনদিন কল্পনাও করেনি টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া বেপরোয়া ওসি প্রদীপ। তাই ঘটনাস্থলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ওসি প্রদীপ ছিল খুবই বিমর্ষ। প্রদীপের ইশারায় বেড়ে উঠা লিয়াকত-নন্দ ও নাকি এখন পরিণতি নিয়ে খুবই শঙ্কিত।
র্যাব সূত্র জানায়, সেদিন এমন কি ঘটনা ঘটেছিলো, সিনহাকে এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে গুলি করা হয়েছিলো- এই প্রশ্নের উত্তর জানতে প্রধান তিন আসামীকে ঘটনাস্থলে নেয়া হয়। খুনের ঘটনাস্থল পৌঁছার পর র্যাবের তদন্ত দল প্রথমে ঘটনাস্থল এবং আশপাশ ঘুরে দেখেন। দুপুর ২টা পর্যন্ত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ার, র্যাবের আইন ও মিডিয়া উইং প্রধান লে. কর্ণেল আশিক বিল্লাহ এবং সিনহা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক সিনিয়র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ঘটনাস্থল ও আশপাশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এসময় সেখানে স্থানীয় লোকজনের সাথেও কথা বলেন র্যাবের কর্মকর্তারা।
র্যাব তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো তদন্তের অংশ হিসেবে কিভাবে সিনহাকে হত্যা করা হয়েছিলো তার প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে ঘটনার রেকি অর্থাৎ রেকি (লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ, আক্রমণপূর্ব পর্যবেক্ষণ, আক্রমণের কলাকৌশল) শুরু করেন। এই জন্য একটি সাদা কার ব্যবহার করা হয়। আসামীদের বর্ণনা মতে রেকি পরিচালনা করা হয়। বেলা ৩টার দিকে রেকি সম্পন্ন হয়।
রেকিতে ওই ঘটনার সাথে মিল রেখে প্রথমে এসআই্ নন্দ দুলালকে গাড়ি থেকে তার ভূমিকার চিত্র ধারণকরা হয়। এরপর লিয়াকত আলী ও সর্বশেষ সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের রেকি নেয়া হয়। এসময় তাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। রেকি পরিচালনা করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। রেকি শেষ করেই র্যাবের তদন্ত দল ঘটনাস্থলে ছেড়ে চলে আসেন।
বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বরখাস্ত হওয়া ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও বরখাস্ত হওয়া এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে আদালতের নির্দেশ মতে গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে রিমান্ডের জন্য হেফাজতে নিয়ে যায় র্যাব। আজকের করা রেকিও রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদের অংশ বলে জানিয়েছে র্যাব সূত্র।
উল্লেখ্য গত ৩১ জুলাই খুন হওয়া মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান টেকনাফের বাহারছড়ায় পুলিশ চেকপয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এরপর ৫ আগস্ট তার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দলাল রক্ষিত, সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া সহ ৯জনকে আসামী করে টেকনাফ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।
পরে মামলা টেকনাফ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু হয়। এই মামলায় এজাহারভুক্ত নয় আসামীর মধ্যে সাত জন গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়াও পরে আসামীভুক্ত বাহারছড়ার স্থানীয় তিনজন ও এপিবিএন এর তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় এপর্যন্ত ১৩ আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২ জন আসামী পুলিশ সদস্য এখনো পলাতক রয়েছে।
সিনহার গাড়ি ও পিস্ততল এখন র্যাবের কাছে:
মেজর (অব.) সিনহার পিস্তল ও গাড়িখানা সহ সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত জিনিসপত্র গুলো র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম এগুলো পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে। ওদিকে টেকনাফ থানার থেকে গায়েব হওয়া ১২ দিনের সিসিটিভি ফুটেজ গুলো ফিরে পেতে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন র্যাব। আদালত বিষয়টি শুনানির জন্য রেখেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
শিপ্রার ২৯ প্রকার সামগ্রী র্যাবের কাছে হস্তান্তর:
পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খানের সহযোগী শিপ্রার ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও নগদ টাকাসহ জব্ধকরা ২৯ প্রকার সামগ্রী রামু থানা পুলিশ র্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে।
গত ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ার পর হিমছড়ির নীলিমা রির্সোট থেকে রামু থানা পুলিশ শিপ্রা ও তার আরেক সহযোগীকে আটক করে এবং এই সামগ্রী গুলো জব্ধ করেছিল।
এই সামগ্রী গুলো সিনহা হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাবকে হস্তান্তরের জন্য গত বুধবার আদালতে আবেদন করেছিল র্যাব। শুনানী শেষে সামগ্রী গুলো র্যাবের কাছে হস্তান্তরের আদেশ দেয় আদালত । কিন্তু বৃহস্পতিবার রামু থানা পুলিশ এই সামগ্রী গুলো তাদের হেফাজতে রাখার আবেদন করলে আদালত তা না নাকস করে র্যাবের হেফাজতে দেয়ার নির্দেশ বহাল রাখেন।
এই আদেশের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাতে রামু থানা পুলিশ ওই সামগ্রী গুলো র্যাবের কাছে হস্তান্তর করে। রাত পৌনে ১২ টায় কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার র্যাবের পক্ষ থেকে এইগুলো বুঝে নেন। এসময় রামু থানার ওসি আবুল খাইরসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।