রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেক্স : বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছেলে শিশুরাও। পুলিশের ধারণা, শিশুরা একশ্রেণীর মানুষের যৌন বিকৃতির টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
ঘটনা ১ : আট বছরের শিশু সামিয়াকে (প্রকৃত নাম ব্যবহার করা হচ্ছে না) ঘরে রেখে এলাকার পানির কল থেকে পানি আনতে গিয়েছিলেন তার মা। ঘিঞ্জি এলাকার খুপরি ঘরগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। মনের মাঝে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও শিশুকন্যাটিকে একাই রেখে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ফিরে এসে মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তার মা। শিশুটির মা বলেন, ‘তিন মাস আগে রাত ৯টার দিকে আমি পানি আনতে গেলাম। মেয়ে বললো, সে একাই ঘরে থাকতে পারবে। এরপরে আমি পানি নিয়ে এসে দেখি আমার বাচ্চা ঘরে নাই। তখন ভাবলাম পাশের বাড়িতে যে পুরুষ লোকটি বসা ছিল, সে কোথায় গেল? তখন আমি পাশের বাড়ির দরজা ধাক্কাই, কিন্তু কেউ খোলে না।’ শিশুটির মা কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারেন তার মাত্র আট বছরের শিশুটিকে প্রতিবেশী বৃদ্ধ ধর্ষণ করেছে। তিনি বলেন, ‘কী হয়েছে বাচ্চাটা পুরোপুরি খুলে বলতে পারছে না। বলে মা, দাদা আমার পাজামা খুলে দিয়েছে। নিজের কাপড় খুলেছে। আমি খেলতেছিলাম। মুখ চেপে ধরে নিয়ে গেছে। প্রতিবেশী তো। তাই দাদা ডাকতো।’
সাত মাসে ২৮০ শিশু ধর্ষণের শিকার : আড়াইশোর বেশি মানবাধিকার সংগঠনের জোট শিশু অধিকার ফোরামে বলছ, গত সাত মাসে বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুল সহীদ মাহমুদ বলেন, গতবছর এই সংখ্যা ছিল ১৯৯টি। আর ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ছিল ৮৬টি। এই সংখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও থাকতে পারে।
ঘটনা ২ : কিছুদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি আবাসিক মাদ্রাসার ছাত্রটি তার নিজের শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় পুলিশ ওই শিক্ষককে আটক করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক মাদ্রাসা শিক্ষক নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তবে এই বিষয়টিতে ধর্ষণের শিকার ছেলেটির পরিবারের সদস্যরা প্রথমে উদ্যোগ নিলেও পরে আর মামলা করতে এগিয়ে আসেননি বলে জানান মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন। পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। বেশিরভাগ শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা এভাবেই আড়ালে থেকে যায় বলে উল্লেখ করছেন শিশু অধিকার ফোরামের আবদুল সহীদ মাহমুদ। তিনি জানান, মেয়ে শিশুদের পাশাপাশি ছেলে শিশু ধর্ষণের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে ছেলে শিশুদের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্র এখন আরো বেড়েছে। সহীদ মাহমুদ বলেন, ‘ছেলে এবং মেয়ের আনুপাতিক হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ছেলেদের ধর্ষণের ঘটনা আগে সীমিত ছিল। বোর্ডিং স্কুল বা মাদ্রাসায় হত। এখন সেই ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। লঞ্চ-ঘাটে, বাস টার্মিনালে কিংবা বিপণি বিতানে যেসব শ্রমজীবী শিশু থাকে কিংবা যারা পথশিুশ তারাও ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে। তবে সেগুলো চার দেয়ালের বাইরে আসে না।’
ঘটনা ৩ : এ ধরনের ঘটনা যে হালে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে তেমনটি বলতে রাজি নন অনেকেই। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সদ্য স্নাতক শেষ করা রেজাউর রহমান (ছদ্মনাম)। খুব ছোটবেলায় কাছের একজন আত্মীয়ের দ্বারাই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তিনি জানান, ‘তখন আমি ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি। তো আমি আমার এক বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে বোনের দেবরের সঙ্গে আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয়া হয়। তো রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম সে তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে আমার পশ্চাদ্দেশে গুঁতো দিচ্ছে। আমি উঠে কি হয়েছে জানতে চাইলে সে বলে তার হাত লেগেছে। এরপর আমি আবারো ঘুমিয়ে পড়লে সে একই কাজ আবার করে। এবং প্রায় সারারাতই সে এই কাজটি করে।’ এরপরও আর দুয়েকবার এ ধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। রেজাউরের শিশুমনে বিষয়টি তৈরি করেছিল ভয় আর আতঙ্কের এক প্রতিক্রিয়া। সেই অনুভূতি তাকে আজও তাড়া করে। বিষয়টি এই প্রতিবেদক ছাড়া আর কারও কাছেই শেয়ার করতে পারেননি তিনি।
সংখ্যা বাড়ছে নাকি খবর প্রকাশ হচ্ছে? নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের অধীনে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সেবায় গঠিত সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকল্পটির পরিচালক আবুল হোসেন বলছেন, নির্যাতনের ঘটনাগুলো আগের মতই ঘটে চলেছে। তবে তা প্রকাশ পাচ্ছে আগের তুলনায় বেশি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসেব মতে, সংখ্যা আসলে বাড়েনি, বরং মানুষের প্রকাশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক কারণে মিডিয়ার কারণে খবরগুলো আসছে। বিষয়গুলো ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কমিউনিটিতে সেটা জানাচ্ছে।’
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান : শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়া কিংবা শিশু ধর্ষণ বাড়ার কারণ হিসেবে অনেকই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে, শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ সদরদপ্তরের গণমাধ্যম বিভাগের এআইজি মো. নজরুল ইসলাম বলছেন, শিশুরা এখন একশ্রেণীর লোকের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক শিশু ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। তারা শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে। একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফির প্রভাব রয়েছে। শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নানা শ্রেণীর এবং বয়সের ব্যক্তিরা এটি করছে।’ শিশুদের ওপর বল খাটানো বা প্রভাবিত করা, ভয় দেখানো সহজ হয়। ফলে সেই সুযোগটি নিচ্ছে অপরাধীরা।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি : শিশুদের ওপর নির্যাতনের বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলছেন, মূলত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা বাবা শ্রমজীবী বাবা-মায়েদের এবং তাদের অনুপস্থিতিতে এইসব শিশুদের দেখার কেউ থাকে না, তারা এসবের শিকার হয়। আরেকটি গ্রুপ যারা নিজেরাই কর্মজীবী তারা, এবং গৃহকর্মীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। তিনি বলছেন, অনেকে অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘অনেকে শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন, অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অনেক দেশে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়।’ এতে শিশু মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ জীবনে তাদেরও এ ধরনের অপরাধ কর্মে জড়ানোর আশংকা থাকে। এইসব শিশুরা স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন না। সেও অন্যের প্রতি এমন আচরণ করে।’
বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা : ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে বলে জানান শিশু অধিকার কর্মীরা।
ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কি ভাবছে রাষ্ট্র? মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ তুলছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে হয়তো অপরাধের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তবে অপরাধী জামিন পাবে না -আইনজীবী হিসেবে তো সেটা বলা যায় না। সুতরাং শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে যদি আলাদা সেল করা হয় , মামলার গতি তদারকি করা হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে। ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। বিষয়টি আরও সহজ করার যায় কিনা- এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, শিশু ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করা যেতে পারে, যেখানে শিশু ভিকটিমকে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে না। তিনি বলেন, ‘আইন সংশোধন করা যেতে পারে এভাবে যে, এক্সপার্টদের কাছে ভিকটিমকে নেয়া হবে। এরপর তারা রিপোর্ট দেবে। এরপর আর কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে না। ওই চিকিৎসকদের রিপোর্টের ভিত্তিতে চার্জশিট দেবে পুলিশ। চিকিৎসকদের সাথে মানবাধিকার কর্মীও থাকতে পারেন।’
বিচারের দীর্ঘসূত্রতা : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনিয়তার কথা বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা। তবে এ বিষয়ে অ্যটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিচারক স্বল্পতা এখানে একটি সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া মামলা ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ডিফেন্স ল ইয়ারের মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে।
সামাজিক হেনস্থা : শেষ করার আগে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই মিরপুরের আট বছরের শিশুটির কথা। চলে আসবার আগে তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম শিশুটি এখন কেমন আছে? উত্তরে তিনি জানালেন, এই ঘটনার পর থেকে শিশুটি পুরুষ মানুষ দেখলেই আতঙ্কিত হয় পড়ছে। তার নিজের পিতাকেও সে সহ্য করতে পারছিল না। ধর্ষণকারী বর্তমানে কারাগারে আটক থাকলেও তার পরিবার বিষয়টি আপোসে মিটিয়ে ফেলতে চাপ দিচ্ছে। নির্যাতিত শিশুর পরিবারটি আপোসে রাজি নয় মোটেই। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পেলে আবার কোনো ক্ষতির মুখে পড়তে হয় কিনা সেই আশঙ্কায় রয়েছে এই পরিবারটি। দেখা যাচ্ছে নির্যাতনের শিকার হয়েও সামাজিক হেনস্থার ভয়ে কোণঠাসা থাকছে নির্যাতিত শিশুটির পরিবারটিই। সূত্র: বিবিসি বাংলা।