শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার: একটি সড়কের মালিক তিনজন এমপি; তারপরও সড়ক দিয়ে সাধারণ মানুষ ও যানবাহন চলাচল করতে পারেনা, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ একেবারে উদাসিন মনোভাব দেখাচ্ছেন। ব্যস্ততম এ সড়কটি হচ্ছে দিরাই-মদনপুর সড়ক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম ব্যবসা ও ধানের শহর সুনামগঞ্জের দক্ষিণ দিকে দিরাই উপজেলার অবস্থান। সিলেট-সুনামগঞ্জ সংযোগ সড়কের মদনপুর নামক স্থান দিয়ে দিরাই উপজেলায় প্রবেশ করতে হয়। এ উপজেলার সাথে সংযোগ দিয়ে জেলার সাথে যোগাযোগকারী একমাত্র উপজেলা হচ্ছে শাল্লা। এই দুই উপজেলার লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সুনামগঞ্জের আদালতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে ‘দিরাই-মদনপুর’ সড়কটি। আর এই সড়কটি দেশের প্রভাবশালী তিনজন সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকার মধ্যে পড়েছে। তারা হলেন উপমহাদেশের বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান ও আইনবিদ সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুনামগঞ্জ-৩ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর) আসনের সংসদ সদস্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান ও সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের সংসদ সদস্য জাতীয়পার্টির পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। সূত্র মতে, দিরাই-মদনপুর সড়কটি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বাসস্টেশন হতে শরীফপুর উত্তর পর্যন্ত দিরাই উপজেলা, সেখান থেকে গাগলী পর্যন্ত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা ও সেখান থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের সংযোগস্থল পর্যন্ত সদর উপজেলার অংশে রয়েছে। ফলে ব্যস্ততম একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের তিনজন বর্তমান সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকায় থাকলেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা চোখে পড়েনা। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নানের মতো একজন প্রতিমন্ত্রী থাকার পরও এ এলাকার উন্নয়নে কোন দৃশ্যমান কাজ না থাকায় সাধারণ মানুষের যেমনি কষ্ট পোহাতে হচ্ছে, তেমনি বিগত দিনের তার উন্নয়নমূলক কাজের মনোভাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মাত্র ২৬ কিলোমিটার সড়কের মালিক তিনজন সংসদ সদস্য হওয়ার পরও গত প্রায় এক বছর থেকে রাস্তাটির বেহাল দশার কারণে ঘন ঘন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ সড়কে প্রতিদিন যাত্রীবাহী বাস, লাইটেস, কার, লেগুণা, ফোরস্টোক, অটোগাড়ি, টমটম ও মালামাল পরিবহণের ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরণের যানবাহন চলাচল করছে। এছাড়া প্রতিরাতে দিরাই থেকে ৬টি কোম্পানীর ৭টি গাড়ি রাজধানীর সাথে সরাসরি চলাচল করছে। দিরাই-মদনপুর সড়কের ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ১০ কিলোমিটার রাস্তা মোটামুটি ভালো, বাকিগুলো ভাঙাচোরা ও বিরাট বিরাট গর্ত এবং রাস্তার ইট-বালু উঠে গিয়ে জন ও যান চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরা এদিকে চলাচল করলেও এ রাস্তার দিকে তাদের কোন খেয়াল দিতে দেখা যায়নি। মাত্র ২৬ কিলোমিটার রাস্তায় প্রায় অর্ধশত মোড় রয়েছে; এর অধিকাংশই বিপজ্জনক অবস্থায় থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন মোড়কে চিহ্নিত করে সতর্কবাণী লেখা চোখে পড়েনি কিংবা অধিক দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকাও চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে সরকারের গাফিলতি আর অযোগ্য চালকদের দৌরাত্বে প্রায়ই এ সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা, সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে শুধুমাত্র দিরাই থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪৬৫টি যাত্রীবাহী গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। তাতে গড়ে প্রায় ৮ হাজার ৬৫৮ জন যাত্রী নিজেদের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন। তবে এ সংখ্যা আরো অধিক বলে অনেকেই জানান। সূত্র মতে, দিরাই থানাপয়েন্ট হতে বাসস্টেশন পর্যন্ত প্রতিদিন যে গাড়িগুলো যাত্রী পরিবহণ করছে, সেগুলো হলো যাত্রীবাহী ৭০টি; তাতে গড়ে ২ হাজার ৮শত জন, লেগুণা ২শতটি, তাতে গড়ে ২ হাজার জন; ফোরস্টোক ১৫০টি, তাতে গড়ে ৬শত জন; কার-লাইটেস ২০টি, তাতে গড়ে ৩ হাজার জন; ইজিবাইক ১৮টি, তাতে গড়ে ১০৮ জন; দিরাই থেকে ঢাকায় যায় নাইটকোচ ৭টি, তাতে গড়ে ১৫০ জন চলাচল করে। এছাড়া এ রাস্তা দিয়ে মোটর সাইকেল, ট্রাক ও কাভার্ট ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে। বেশ কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করে বলেছে, দিরাই-মদনপুর সড়কে প্রতিদিন করে হলেও এক থেকে দেড় লাখ লোক চলাচল করে।
দিরাই বাসস্টেশনের বেশ কয়েকজন গাড়িচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মানববন্ধন বা সাধারণ কোন কর্মসূচিতে এ রাস্তার কোন উন্নয়ন হবেনা। যদি এ রাস্তায় চলাচলকারী সকল ধরণের গাড়ি চলাচলের ওপর ধর্মঘট ডাকা হয়, তবেই সরকার বাধ্য হবে এই রাস্তার সঠিকভাবে উন্নয়ন করতে। কারণ, আমরা প্রতিদিন সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই গাড়ি চালাই; অথচ রাস্তার বেহাল অবস্থায় কেউ কোন ধরণের টু-শব্দটি করেনা। তারা আরো জানান, প্রতিদিন সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে এবং আমাদের গাড়ির যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা অতিদ্রুত এ রাস্তার সংস্কার দেখতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সকলের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
অন্যদিকে দিরাই বাসস্টেশন হতে ‘দিরাই-মদনপুর’ সড়কের উভয়পার্শ্বে প্রায় অর্ধশতাধিক মাছের পুকুর রয়েছে। ফলে পুকুরের মাছ এসব পুকুরের মাটি খেয়ে সড়কের নিচের দিকে বিরাট গর্ত করে ফেলছে। এ কারণে সড়কটি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে প্রায়ই গাড়ি বা ট্রাকসহ দেবে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ সকল পুকুরে মাছ চাষ বন্ধের কোন উদ্যোগ নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এতে করে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, দিরাই-মদনপুর সড়কের ৮ কিলোমিটার সংস্কার কাজের জন্য ইতিমধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে, সে জন্য ৫৬ লাখ টাকা বরাদ্ধ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, রাস্তার পূর্ণ সংস্কারের জন্য এ বরাদ্ধ কম হওয়ায় আমরা এক কোটি টাকারও বেশি চেয়েছি। বেশি নষ্ট হওয়া অংশ বিশেষ করে এ রাস্তার বাজার এলাকার সুরক্ষার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে সংস্কার করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, দিরাই-মদনপুর সড়কটি মূলত এক সময়ের ছোট রাস্তা থেকে হওয়ায় এটি এখন পর্যন্ত সরকার ভূমি অধিগ্রহণ না করার কারণে একক মালিকানা দাবি করতে পারছেনা, এর কারণে উভয়পাশের পুকুর নিয়ে কোন এ্যাকশনেও যাওয়া যাচ্ছেনা।