শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
হাওরপাড়ের কৃষকের বুকফাটা আর্তনাদের বহি:প্রকাশ: ‘নিজের নয়, গরুর জন্যই ধান কাটছি’

হাওরপাড়ের কৃষকের বুকফাটা আর্তনাদের বহি:প্রকাশ: ‘নিজের নয়, গরুর জন্যই ধান কাটছি’

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার: ‘আমার জন্য নয়, কয়েকটা গরুর জন্যই এখন আমাকে ধান কাটতে হচ্ছে’ বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন উজানধল গ্রামের কৃষক শাবান মিয়া। গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে আসা পানিতে তলিয়ে গেছে প্রান্তিক কৃষকদের স্বপ্নের বোরো ধান। গতকাল (রোববার) সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বিভিন্ন হাওরে সরেজমিন গেলে এমন চিত্র দেখা যায়। এখন পর্যন্ত হাওরে আবাদকৃত বোরো ধান পরিপক্ক ছড়ায় পরিণত হয়নি, বর্তমানে ফুল ও দুধে অবস্থান করছে উপজেলার বিশাল হাওরগুলোর কাচা ধান।
দিরাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নে মোট ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। গত কয়েকদিনের উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টির কারণে ইতিমধ্যেই উপজেলার বেশ কয়েকটি হাওরে পানি প্রবেশ করে ডুবে গেছে কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের সোনালী ফসল। সূত্র জানায়, বাঁধ ভেঙে ও জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৮শত হেক্টর বোরো ধান, এরমধ্যে শুধুমাত্র বাঁধ ভেঙে ৩ হাজার ৩শত হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া জলাবদ্ধতায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে ৩ হাজার ৫শত হেক্টর। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র আরো জানায়, এ পর্যন্ত তুফানখালি, বৈশাখি ও পুটিজুড়ি বাঁধ ভেঙে ছোট-বড় ৯টি হাওর আক্রান্ত হয়েছে। এ কারণে তাড়ল, জগদল ও কুলঞ্জ ইউনিয়নে বেশি ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিয়েছে। তাদের হিসেব মতে, হাওরে এখন পর্যন্ত বোরো ধানের চিত্র হলো দানাতে আছে ১৪ শতাংশ, ফুলে আছে ৬০ শতাংশ ও দুধে আছে ২৫ শতাংশ। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে জানা গেছে। এখনও বাঁধ ভেঙে ও সড়ক ডুবে নদী-হাওরে প্রতিদিনই পানি প্রবেশ করছে হু হু করে।
উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামের কৃষক শাবান মিয়া বলেন, নিজের জন্য ধান কাটছি না, বাড়িতে কয়েকটি বোবা গরু রয়েছে, তাদের আহারের জন্যই এই কাচা ধান কাটতে হচ্ছে বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এ বছর তিনি ২০ বেদার বোরো জমি করেছিলেন বলেও জানান। এখন পর্যন্ত কোন ধানই পরিপক্ক হয়নি, ইতিমধ্যে হাওর ডুবতে বসেছে। তিনি আক্ষেপ বরে বলেন, প্রতি বছরই আমাদের কৃষি নিয়ে বাড়তি কষ্ট করতে হচ্ছে। নরোত্তমপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আজিজ আক্ষেপ করে বলেন, ধান পরিপুষ্ট হয়নি, তারপরও তা কাটতে হচ্ছে। কারণ, যদি এ ধান থেকে কিছুই পাবো না, শুধুমাত্র মনকে শান্তনা দিতেই এ কাজ করছি। কাদিরপুর গ্রামের কৃষক নিয়ামত আলী জানান, ধান এখনও পাকেনি, তারপরও কাচা ধান কাটছি। হাওরে প্রতিদিনই পানি বাড়তেছে, রাত পোহালে যে এই ক্ষেতে ধানের চিহ্ন পাবো, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বলেই কাচা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছি। এ বছর তিনি ১ হাল জমিতে বোরো আবাদ করেছেন বলেও জানান।
এদিকে দিরাই উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের কাছে বেড়িবাঁধ নির্মাণে কত টাকা এসেছিল-জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এখন হাওরে আছি, ২/৩ দিন পর ফোন দিলে জানতে পারবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এ পর্যন্ত বেড়িবাঁধের কাজ ৭০-৮০ শতাংশ হয়েছে। ৩১শে মার্চের ভেতরে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করা কথা বলেই মোবাইলের লাইন কেটে দেন। এরপর কয়েকবার তাকে ফোন করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেন নি।
দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান তালুকদার জানান, দিরাইয়ে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে আমরা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বাঁশ, গুড় ও চিড়া নিয়ে গেছি। মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কাজে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা না থাকায় আমরা যেমন জোর দিয়ে কথা বলতে পারিনা, তেমনি তাদের কোন কাজ পরিদর্শনও করতে পারিনা। তারপরও আমরা মাঝে মধ্যে স্বউদ্যোগেই মাঠে গিয়ে পরিদর্শন করে আসি। তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ করে আমাদের কৃষকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল নিয়ে যায়, এ নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের একাধিক বৈঠকে কথা বলেছি, কিন্তু কোন কাজের কাজ হচ্ছেনা। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনীত একজন প্রতিনিধি সমন্বয়ে বেড়ি বাঁধগুলোর কাজ হয়ে থাকে। এসব কমিটিতে পিআইসি থাকেন ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ। ফলে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজেসে কাজ না করেই প্রতি বছর টাকা উত্তোলন করেন। আমাদের কোন কথাই তারা শুনতে চায়না উল্লেখ করে তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। তাদের কাজে আমাদের সম্পৃক্ততা করার ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে আগেও দাবি করেছি, এখনও দাবি করছি উল্লেখ করে উপজেলা চেয়ারম্যান আরো বলেন, যদি এ সকল কাজে অন্তত আমাদের কাছ থেকে একটি প্রত্যয়ন নেয়ার ব্যবস্থা থাকতো, তবে হয়ত কাজ আরো ভালো হতো এবং দুর্নীতি কম হতো।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের নবনির্বাচত সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা গতকাল (রোববার) উপজেলার বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করেছেন। পরে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, বাঁধ ভেঙে ও উজান থেকে আসা ঢলের কারণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে, আমরা কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছি, বাঁধগুলো রক্ষার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যেহেতু নতুন নির্বাচিত হয়েছি, এখন পর্যন্ত সবগুলো বিষয়ে খোঁজখবর নিতে পারিনি, তাই আমি একথা বলবো যে, সকলের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এত বড় কাজ সম্ভব নয়। তবে একথা সত্য যে, গত কয়েকদিনে যা দেখলাম, তাতে মনে হয়েছে এখানে স্থানীয় প্রশাসনের তেমন কোন ভূমিকা নেই। এ রকম অবস্থা আর চলতে দেয়া হবেনা উল্লেখ করে ড. জয়া সেনগুপ্তা আরো বলেন, প্রতি বছর কৃষকদের নিয়ে রাজনীতি ও দুর্নীতি করার সুযোগ দেয়া হবেনা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনগণসহ সকলের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে টেকসই ও স্থায়ীভাবে কাজ করতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com