হাফিজ মাওলানা জিয়াউর রহমান:
ইতিকাফের শাব্দিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ
ইতিকাফ আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থে ইতিকাফ হলো অবস্থান করা, কোনো স্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় ইতকিাফ হলো ইবাদত ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে, পুরুষের জন্য মসজিদে এবং মহিলাদের জন্য আপন ঘরে সালাত আদায়ের জায়গায় অবস্থান করা।
ইতিকাফের প্রকার ও সময়:
সাধারণতঃ শরয়ী বিধানের তারতম্য অনুসারে ইতিকাফ তিন প্রকার। যথা-
এক. ওয়াজিব ইতিকাফ; এটা হলো মান্নতের ইতিকাফ। নিয়ত অনুসারে যে কোনো সময়ে এ ইতিকাফ করা যায়।
দুই. নফল ইতিকাফ; রমযানের শেষ ১০ দিন ছাড়া বছরের অন্য সময়ে যত ইতিকাফ করা হয়, তাই নফল ইতিফের অন্তর্ভুক্ত।
তিন. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ; রমযানের বিশ তারিখের সূর্যাস্ত থেকে ঈদের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (তাবয়ীনুল হাকায়েকঃ ১/৩৪৮; মা’আরিফুস সুনানঃ ৬/১৯১; দরসে তিরমিযী-তাকি উসমানীঃ ২/৬৩০)
কুরআন ও হাদীসের বর্ণনায় ইতিকাফ:
ইতিকাফের প্রচলন ইসলামের বহু আগে থেকেই রয়েছে। সালাত এবং অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে ইতাকাফকারীদের জন্য বায়তুল্লাহকে পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-অর্থঃ আমি ইবরাহীম ও ইসামাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সূরা বাকারাহ-১২৫)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক রমযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। তবে ওফাতের বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেছেন। (সহীহ বুখারীঃ হা-২০৪৪)
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের মাঝে যত দূরত্ব আছে, তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। (শুআবুল ঈমান-বায়হাকীঃ হা-৩৯৬৫)
সুন্নাত ইতিকাফের বিধান:
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মাদানী জীবনে মাত্র একটি রমযানে জিহাদের সফরের কারণে ইতিকাফ করতে পারেননি। পরবর্তী বছর ২০ দিন ইতিকাফ করে তা পূরণ করে নিয়েছেন। এ বছর ছাড়া তিনি অন্য সময়ে একটি ইতিকাফও ছাড়েননি। সাহাবীগণও তাঁর সাথে ইতিকাফে শরিক হতেন। তাই ইতিকাফ একটি মর্যাদাপূর্ণ মাসনূন আমল। রমযানে কোনো মসজিদ ইতিকাফশূন্য থাকলে পুরো এলাকাবাসী সুন্নতে মুআক্কাদা বর্জনের গুনাহগার হবে।
ইতিকাফের উপকারিতা:
১. শবে কদর অন্বেষণের অন্যতম মাধ্যম হলো ইতিকাফ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের ২১তম রাত আসলো, তখণ তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে, সে যেনো শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিলো, কিন্তু এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা শবে কদর রমযানের শেষ দশকে খোঁজ করো। (সহীহুল বুখারীঃ হা-২০২৭)
২. ইতিকাফকারী অবসর সময়ে কোনো আমল না করলেও তার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হয়।
৩. ইতিকাফের বদৌলতে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। পাপাচারের সয়লাব থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তা’আলার ঘর যেনো একটি প্রকৃত দূর্গ।
৪. ইতিকাফ দ্বারা দুনিয়ার বহু ঝামেলা থেকে মুক্ত করে নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহ তা’আলার কাছে সঁপে দেওয়া হয়। সিয়ামের কারণে পুরো দিন ফিরিশতাদের সাথে (পানাহার ও যৌনকর্ম বর্জন দ্বারা) সামঞ্জস্য হয়। আর ইতিকাফের দ্বারা ২৪ ঘণ্টা ফিরিশতাসূলভ আচরণের উপর অবিচল থাকার চমৎকার প্রশিক্ষণ হাসিল হয়।
৫. সিয়ামের যাবতীয় আদাব ও হক যথাযথ আদায় করে পরিপূর্ণ সিয়াম আদায় করার জন্য ইতিকাফ যথেষ্ট কার্যকর।
৬. ইতিকাফ আল্লাহ তা’আলার মেহমান হয়ে তাঁর সাথে মুহাব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি করার অন্যতম মাধ্যম। সশ্রদ্ধ একান্ত সংলাপের জন্য ইতিকাফের বিকল্প বিরল।
ইতিকাফের জরুরি মাসায়েল:
ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের জন্য সিয়াম রাখা আবশ্যক। তবে নফল ইতিকাফের জন্য সিয়াম রাখা জরুরি নয়।
মাসনূন ইতিকাফ যেহেতু শেষ দশ দিন ব্যাপী, তাই প্রথম থেকেই পুরো দশ দিন ইতিকাফ করার নিয়ত করবে। এক সাথে দশ দিনের নিয়ত না করলে সুন্নাত ইতিকাফ আদায় হবে না; বরং তা নফলে পরিণত হবে।
২০ তারিখ সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে পৌঁছে যাওয়া আবশ্যক।
মাসনূন ইতিকাফ শুরু করলে তা পূর্ণ করা আবশ্যক। ওযর ব্যতীত তা ভাঙ্গা জায়েয নেই।
ইতিকাফকারীর জন্য ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা হারাম। তেমনি স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া অথবা আলিঙ্গন করা ইত্যাদি সব কিছুই না-জায়েয।
মাসনূন ইতিকাফ শুরু করার পর মাঝে দু-এক দিন যদি ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে সে দিনগুলোর ইতিকাফ পরে কাযা করে নিতে হবে। অর্থাৎ যে কয়দিনের ইতিকাফ ভঙ্গ হয়েছে, সে কয়দিনের জন্য সিয়াম অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করবে।
পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানো উভয়ই না-জায়েয।
ইতিকাফের দিনগুলোতে তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ও ইবাদত-বন্দিগীতে কাটানো উত্তম।
কিছু সময় দীনি মাসায়েলের কিতাবাদি পড়াশোনা করা এবং অন্যকে শোনানো উচিত।
পুরুষরা শুধু মসজিদে ইতিকাফ করবে। আর মহিলারা তাদের ঘরে সালাত আদায়ের জায়গায় ইতিকাফ করবে।
মহিলারা তাদের ইতিকাফের স্থানকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিবে, যেনো কোনো বে-গানা পুরুষ আসলে স্থান পরিবর্তন করতে না হয়।
অজ্ঞান বা পাগল হয়ে গেলে ইতিকাফ নষ্ট হয় না। তবে তা যদি পরবর্তী দিন বা আরো বেশি সময় পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে প্রথম দিন বাদ দিয়ে যে কয়দিন এ অবস্থায় কাটে, সেগুলোর কাযা করে নিতে হবে।
ইতিকাফ সহীহ হওয়ার জন্য যে কোনো মসজিদ হলেই চলবে। অর্থাৎ জামে সমজিদ হোক বা পাঞ্জেগানা- উভয়টিতেই ইতিকাফ করা যায়।
ইতিকাফ অবস্থায় যা কিছু করা যায়:
অন্যান্য সিয়াম আদায়কারীর মতো রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়া কিংবা চা পান করা ইত্যাদি সবকিছুই ইতিকাফকারীর জন্য জায়েয।
প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথাবর্তা বলা জায়েয।
প্রয়োজন মতো আরাম করা ও ঘুমানো জায়েয।
জরুরি চিঠিপত্র লেখা এবং ধর্মীয় বইপত্র লেখা জায়েয।
মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় শুধু প্রয়োজনীয় বেচাকেনা সংক্রান্ত কথাবর্তা বলা জায়েয। তবে বিক্রয়পণ্য মসজিদের ভিতর প্রবেশ করানো যাবে না।
ইতিকাফকারী চিকিৎসক প্রয়োজনবশত ইতিকাফ অবস্থায় বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসাপত্র লিখতে পারবে।
মল-মুত্র ত্যাগ, ওযুু, (ফরয ও নফল) ফরয গোসল ও সুন্নাত গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।
খাবার মসজিদের পৌঁছে দেওয়ার কেউ না থাকলে নিজে গিয়ে তা আনতে পারবে।
মুয়াযযিন ইতিকাফ করলে এবং আযানের জায়গা মসজিদের বাইরে হলে বাইরে গিয়ে তার জন্য আযান দেওয়া জায়েয।
পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফ করলে জুমু’আর সালাত আদায়ের জন্য জামে মসজিদে যাওয়া জায়েয।
জুমু’আর শেষে ইতিকাফের স্থানে ফিরে আসবে।
ওযু-ইসতিঞ্জার জন্য বের হলে যদি কোনো জানাযা উপস্থিত থাকে, তাহলে পথে বিলম্ব না করে জানাযা আদায় করে নেওয়া জায়েয।
ফরয ও মাসনূন গোসল (যেমন জুমু’আর গোসল) ছাড়া স্বাভাবিক গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হবে না। তবে খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দিলে মসজিদের ভিতরে বসে মাথা বের করে দিয়ে মাথায় পানি দিবে। এতেও সমস্যা না কাটলে কোনো কোনো মুফতীর মতে ওযু-ইসতিঞ্জার জন্য যখন বের হবে তখন নিকটে পানির ব্যবস্থা থাকলে অতি দ্রুত গোসল করে নিবে। ইতিকাফ অবস্থায় কুরআন মাজীদ ও দীনী কিতাবের তালীম দেওয়া জায়েয।
ইতিকাফ অবস্থায় শরীরে তেল লাগানো, খুশবু ব্যবহার করা এবং চুল-দাড়ী আঁচড়ানোর অনুমতি আছে।
ইতিকাফ অবস্থায় চুপ থাকাকে সাওয়াব মনে করে চুপ থাকা অর্থাৎ কোনো যিকিরও না করা মাকরূহ তাহরীমী।
মসজিদ একতলা বিশিষ্ট হোক বা বহুতল বিশিষ্ট, ছাদ মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং ইতিকাফকারী ছাদে যেতে পারবে।
মসজিদের বারান্দা যদি মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হয় (অর্থাৎ নির্মাণের সময় বারান্দাকেও যদি মসজিদের অংশ মনে করা হয়ে থাকে) তাহলে সেখানেও ইতিকাফকারী যেতে পারবে।
ইতিাকাফকারী নফল ওযুর জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে।
মহিলাদের ইতিকাফ:
মহিলারা তাদের ঘরে সালাত আদায়ের স্থানে ইতিকাফ করবে। সালাত আদায়ের জন্য আগে থেকে কোনো স্থান না থাকলে তা নির্দিষ্ট করে নিবে। এরপর সেখানে ইতিকাফ করবে।
যে মহিলার স্বামী বৃদ্ধ, অসুস্থ বা তার ছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফের চেয়ে তাদের খেদমত ও সেবাযত্ন করা বেশি উত্তম।
মাসিক (ঋতুস্রাব) অবস্থায় ইতিকাফ করা সহীহ নয়। কারণ এ অবস্থায় সিয়ামই আদায় হয় না। আর মাসনূন ইতিকাফের জন্য সিয়াম রাখা জরুরি।
মহিলাদের উচিত তাদের নির্দিষ্ট দিনগুলোর শুরু-শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ইতিকাফ করা।
মহিলারা তাদের ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘরের অন্যত্র যাবে না। অন্যত্র গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
মহিলাদের ইতিকাফ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিয়েই ইতিকাফ করতে হবে। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ সহীহ হবেনা।
ইতিকাফ ভঙ্গের কারণ সমূহ:
ইতিকাফ অবস্থায় সহবাস করলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। এ ছাড়া স্ত্রীকে চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করার দ্বারা বীর্যপাত ঘটলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
ফরয ও মাসনূন নয়- এমন গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
শিক্ষক ও চাকুরিজীবীরা নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদের বাইরে গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। এ ধরণের দায়িত্বশীলদের জন্য ইতিকাফের আগেই ছুটি নিয়ে নিতে হবে।
অন্য মসজিদে খতম তারাবীর জন্য গেলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
বিনা প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে যদিও তা অল্প সময়ের জন্য হয়, ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
কোনো কারণে সিয়াম ভেঙ্গে গেলে বা সিয়াম রাখতে না পারলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। কারণ মাসনূন ও ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য সিয়াম জরুরি।
দলিল:
(সূরা বাকারাহ-১৮৭; সহীহ মুসলিম; সহীহুল বুখারী; মিশকাতুল মাসাবীহ; বাদায়েউস সানায়েঃ ২/১০৮-১০৯; মুখতাসারুল কুদুরি; ফতোয়ায়ে শামী; ফাযায়েলে রমযান-শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. পৃ-৫১; বেহেশতি যেওর- শামসুল হক ফরিদপুরী অনূদিত, ৩য় খন্ড-ইতিকাফ অধ্যায়)