রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৮ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১

দিরাইয়ে গৃহবধু ফারজানার রহস্যজনক মৃত্যু: পরিবারের দাবি আত্মহত্যা

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
‘তোমরা কেউ এসে আমাকে নিয়ে যাও, সে প্রতিদিন নির্যাতন করতেছে, আমাকে আর বাঁচতে দিবে না মনে হয়’-মৃত্যুর ২ দিন আগে মোবাইল ফোনে এমন কথাই জানায় নিহত ফারজানা বেগম (২৩)। কান্না জড়িতকণ্ঠে জানান নিহতের মা মোছাঃ হোসনে আরা বেগম। তিনি আরো জানান, আমার সহজ-সরল মেয়েকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালিয়ে আসামিরা পার পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী মিজানুর রহমান (৪০)-কে প্রধান আসামি করে আমল গ্রহণকারী সুনামগঞ্জ জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং-২৩৮, ০২/০৭/২০১৮ খ্রিস্টাব্দ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের হলিমপুর গ্রামে।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের বড়মোহা গ্রামের সৌদিআরব প্রবাসি মোঃ বাবুল মিয়ার মেয়ে ফারজানা বেগমকে একই জেলার দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের হলিমপুর গ্রামের মৃত হাজী আব্দুস সোবহানের ছেলে মোঃ মিজানুর রহমানের কাছে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন তাদের দাম্পত্য জীবন ভালো কাটলেও এক সময় জামাতা মিজানুর রহমান অর্থের লোভে প্রায়ই ফারজানাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রবাসি মোঃ বাবুল মিয়া এ পর্যন্ত কয়েক লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও মেয়ের উপর নির্যাতন কমেনি। সর্বশেষ গত একমাস আগেও মিজানুর রহমান ফারজানার কাছে চার লাখ টাকা দাবী করে বলেও মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র মতে, গত ১৪ জুন অনুমান ৭টা ৪২ মিনিটে ফারজানার ব্যবহৃত মোবাইল থেকে তার ভাই সালমান মিয়ার মোবাইলে একটি কল আসে। রিসিভ করার সাথে সাথেই তা কেটে দেয়া হয় অপরপ্রান্ত থেকে। এরপর থেকে ফারজানার মোবাইলে অসংখ্য কল দেয়ার পরও কেউ তা রিসিভ করেনি। এক সময় বাধ্য হয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের মোবাইলেও কল দেয়া হয়, কিন্তু কেউই তা রিসিভ করেনি। ফলে নিহত ফারজানার পিতার বাড়ির লোজনের মধ্যে তার ব্যাপারে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। অবশেষে বাদির পিত্রালয় দিরাই উপজেলার করিমপুর গ্রামে কল দিয়ে ফারজানার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে অনুরোধ করি বলে জানান মামলার বাদি হোসনে আরা বেগম। তিনি আরো জানান, রাত প্রায় ১১টায় আমাদেরকে জানানো হয় যে, আমার মেয়ে ফারজানা অসুস্থ, তাকে নিয়ে দিরাই হাসপাতালে যাওয়া হচ্ছে। এমতাবস্থায় করিমপুরের আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু এক পর্যায়ে জানানো হয় যে, ফারজানা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ খবর পাওয়ার পর বড়মোহা ও করিমপুর গ্রামের আমার আত্মীয়-স্বজনরা হলিমপুর ফারজানার স্বামীর বাড়িতে আসলে সবাই দেখতে পাই যে, তার লাশ মিজানুর রহমানের ঘরের মেঝেতে রাখা হয়েছে। নিহত ফারজানার মা হোসনে আরা বেগম জানান, আমাদের প্রশ্নের জবাবে জামাতা ও তার বাড়ির লোকজন একেক সময় একেক উত্তর দিতে থাকলে আত্মহত্যা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। মামলায় বাদি দাবি করেন যে, যৌতুকলোভী মিজানুর রহমান তার দাবিকৃত ৪ লাখ টাকা না পেয়ে আমার মেয়েকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালিয়ে ঘটনাটিকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। মামলার বাদি হোসনে আরা বেগম এক প্রশ্নের জবাবে জানান, আমার জামাতা যে বড় ধরণের জুয়াড়ি, তা আগে জানতাম না, যখন জানতে পেরেছি, তখন তাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তান হয়ে গেছে, যার বয়স এখন আড়াই বছর। মেয়ে ও তার সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমরা প্রায়ই তাকে টাকা দিয়েছি, এসব টাকা পেয়ে সে জুয়া খেলত। আমার মেয়ে ফারজানা বেগম তার এসব অনৈতিক কাজে বাঁধা দিত এবং ভালো পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করত। আর এসব কারণেই মিজানুর রহমান ফারজানাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। তিনি আরো বলেন, মিজানুরের জুয়া খেলা বন্ধ না হওয়া ও ফারজানাকে নির্যাতনের কারণে একবার মেয়েকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরে আর কোন দিন জুয়া খেলবেনা ও মেয়েকে নির্যাতন করবেনা-এই মর্মে মিজানুরের পিতা জামিন হলে ফারজানাকে স্বামীর বাড়িতে দিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে মামলার বাদি তার এজহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার পর দিরাই থানায় মামলা দিতে গেলে দিরাই থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা তা নিতে গরিমশি করেন। ওসি বলেন, রিপোর্ট পাওয়ার পর মামলা দায়ের করতে হবে। পরে নিরুপায় হয়ে জেলা জজ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। এ মামলায় প্রধান আসামি মিজানুর রহমান ছাড়াও তার মা আবাতুন নেছা (৬৬), ছেলে মোঃ আব্দুল হামিদ (৪৩), মোঃ খলিলুর রহমান (৫০), মোঃ আতিকুর রহমান (৪৭) ও সমছু মিয়ার ছেলে সিদ্দিকুর রহমান (৪১)-কে নারী ও শিশু নির্যাতনে প্ররোচনা ও হত্যা মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে গৃহবধু ফারজানা আত্মহত্যা করেছে বলে নিহতের স্বামী মিজানুর রহমান বাদি হয়ে দিরাই থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছে। মামলা নং-০২, তারিখ ঃ ১৫/০৬/২০১৮ খ্রিস্টাব্দ। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ১৪ জুন সন্ধ্যা ৭.১৫ থেকে ৭.৫০ মিনিটের মধ্যে নিজের ওড়না দিয়ে ফারজানা তার বসতঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ঐদিন সন্ধ্যার পর আমি দিরাই বাজার হতে মাছ নিয়ে বাড়িতে এসে দেখি আমার স্ত্রী ফারজানা ছেলে সিফাত (৩)-কে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। আমাকে দেখে কোথায় গিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করলে আমি জানাই মাছ আনতে দিরাই গিয়েছিলাম। পরে আমি মাছ রেখে আমার মায়ের রুমে চলে যাই। কিছুক্ষণ পর আমার মা আবাতুন নেছা তাকে মাছ কাটার জন্য ডাকতে যান, গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ। পরে আমার বড়ভাই এসেও দেখেন একই অবস্থা। তিনিও অনেক্ষণ ডাকাডাকি করেন, তবে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি এসে জানালা খুলে দেখি সে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। আমার চিৎকারে বাড়ির সবাই আসলে ঘরের দরজা ভেঙে তাকে বাঁচানো যাবে মনে করে সেখান থেকে খুলে ফেলি। এরপর আমার শশুরবাড়ির লোকজন ও স্থানীয় মেম্বারকে ঘটনাটি জানাই।
ঘটনার পর নিহতের স্বামী মিজানুর রহমানের মামা হলিমপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার মোঃ আব্দুল মান্নানকে তারা বিষয়টি অবহিত করেন এবং করণীয় নিয়ে মোবাইলে পরামর্শ করেন, তারা তখন তাবলীগের কাজে ছিলেন। এ সময় একই গ্রামের সাহাবুদ্দিন বিষয়টি জানতে পেরে নিহত ফারজানার এক আত্মীয় উপজেলার করিমপুর গ্রামের হাজিক মিয়াকে মোবাইলে জানান যে, আপনার নাতনি আত্মহত্যা করেছে। এরপর তিনি বিষয়টি করিমপুর ও নিহতের পিতার বাড়ি বড়মোহায় জানান।
হলিমপুর গ্রামের সাহাবুদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানান, ঘটনাটি আমরা এশার নামাযের আগেই জানতে পেরেছি, এরপরই আমি মোবাইলে হাজিক মিয়াকে জানাই।
খবর পেয়ে বড়মোহা ও করিমপুরের আত্মীয়-স্বজন মেয়ের স্বামীর বাড়ি হলিমপুরের লোকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা প্রথমে জানায়, ফারজানা অসুস্থ তাকে দিরাই হাসপাতালে নিয়ে আসতেছি। এর কিছুক্ষণ পর তারা আবার জানায় যে, সে আত্মহত্যা করেছে। পরে করিমপুর ও বড়মোহা থেকে ফারজানার মা-ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনরা গিয়ে দেখতে পান তাকে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মিজানুর রহমান ও তাদের পরিবারের লোকজন একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে বলেও মামলার এজহারে উল্লেখ রয়েছে।
মামলার প্রধান আসামি ও নিহত ফারজানার স্বামী মিজানুর রহমানের মাতা গৃহবধু ফারজানা হত্যা মামলার আসামি আবাতুন নেছা (৮০) এ প্রতিবেদককে জানান, আমার ৬ ছেলে ও ৫ মেয়ে, এরমধ্যে মিজানুর রহমান সৌদিআরবে ছিল। বিয়ের পর এবার নিয়ে ৩ বার দেশে এসেছে, আমাদের কোন টাকা-পয়সার অভাব নেই, কেন সে তার স্ত্রীকে টাকা-পয়সার জন্য নির্যাতন করবে? এ ধরণের ঘটনা সঠিক না। আত্মহত্যা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ দিন আমি এতেকাফে ছিলাম, আমিও শুনেছি সে না কি আত্মহত্যা করেছে।
তথ্যে প্রচুর গড়মিল!
গৃহবধু ফারজানা আত্মহত্যা করেছে, না কি অন্য কোথাও মেরে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে, সংগঠিত ঘটনার তথ্যে প্রচুর গড়মিল পাওয়া যাচ্ছে। নিহত ফারজানার স্বামী মিজানুর রহমানের বাড়ির লোকজনের দেয়া তথ্যেও কোন মিল পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রথমদিকে ফারজানা অসুস্থ বলে খবর দেয়া হয় তার পিত্রালয়ে, কিছুক্ষণ পর আবার তাদেরকে জানানো হয় সে আত্মহত্যা করেছে; এরপর পুলিশকে খবর দেয়ার সময় নিয়ে মিজানুর রহমানের বাড়ির লোকজন ও দিরাই থানা পুলিশের বক্তব্যে কোন সঠিক সময় পাওয়া যাচ্ছে না বলে নানা সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। লাশ দেখতে যাওয়া ফারজানার পিত্রালয় ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরাদের কাছে এসব প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেনি মিজানুরের পরিবার। ফলে স্বভাবতই গৃহবধু ফারজানাকে অন্য কোথাও নির্যাতন করে মেরে ফাঁসের কাহিনী সাজানো হয়েছে বলেই মনে করছেন তারা। এছাড়া ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার প্রকৃত কোন লক্ষণ ফারজানার শরীরে নেই বলে জানান তার মা ও মামলার বাদি হোসনে আরা বেগম।
করিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ড মেম্বার ও হলিমপুর গ্রাম নিবাসি মোঃ আব্দুর রব রিপন জানান, আমি রাত ১০টার দিকে খবর পেয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি লাশ মেঝেতে রাখা হয়েছে, তারা আমাকে আত্মহত্যার বিষয়টি বলেছে। আমার পরিষ্কার বক্তব্য হল প্রকৃত দোষী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হোক; আর নিরপরাধ কেউ যেন ভোগান্তির শিকার না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যে ওড়না দিয়ে আত্মহত্যা করার কথা বলা হয়েছে, সেটির মধ্যে কোন ধরণের ভাজ আমি দেখিনি।
ঘটনার খবর পেয়ে করিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও মামলার অন্যতম স্বাক্ষী মোঃ নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, আমরা রাত ১০টায় খবর পেয়েছি। আমার বক্তব্য হল, প্রকৃত দোষী যে কেউ হোক, তার শাস্তি চাই এবং নিরপরাধ কেউ যেন ভোগান্তির মধ্যে না পড়ে। বাড়ির লোকজন জানিয়েছে যে, ফারজানা ওড়না গলায় দিয়ে ফাঁস দিয়েছে। তবে যে ওড়নার কথা বলা হয়েছে, তাতে কোন চিহ্ন বা ভাজ পাওয়া যায়নি।
দিরাই থানার অফিসার্স ইন-চার্জ (ওসি) মোঃ মোস্তফা কামাল মামলার কাগজ দিরাই থানায় পৌঁছার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ঘটনাটি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি, আসামি ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com