শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক:
আমাদের জেনারেশন এমন এক সময়ে বড় হয়েছে, যখন উপনিবেশ যুগের জের ছিল তীব্র। আমাদের আগের বযস্ক জেনারেশনটা ক্রীতদাসের মতো আচরণ পেয়েছিল এবং ব্রিটিশদের ব্যাপারে ভুগত হীনম্মন্যতায়। যে স্কুলে পড়তাম, তা পাকিস্তানের অন্য সব এলিট স্কুলের মতোই ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পরও এসব প্রতিষ্ঠান ‘পাকিস্তানি’ নয়, ‘পাবলিক স্কুল বয়’ তৈরি করছে।
আমি স্কুলে শেক্সপিয়রের সাহিত্য পড়েছি, যা চমৎকার। কিন্তু জাতীয় কবি আল্লামা ইকবালের লেখা তো পড়িনি। ইসলামিয়াতের ক্লাসকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না। যখন স্কুলজীবন শেষ হলো, আমাকে দেশের এলিটদের একজন বলে গণ্য করা হতো। এর কারণ আমি ইংরেজি বলতে পারতাম আর পাশ্চাত্যের পোশাক পরতাম। আমার নিজস্ব সংস্কৃতিকে পশ্চাৎপদ এবং ধর্মকে সেকেলে মনে করতাম। আমাদের গ্রুপের কেউ ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলে, নামাজ পড়লে কিংবা দাড়ি রাখলে সাথে সাথে সে খেতাব পেত ‘মোল্লা’।
পশ্চিমা মিডিয়ার জোরে পাশ্চাত্যের চিত্রতারকা কিংবা পপস্টাররাই ছিল আমাদের চোখে ‘হিরো’। যখন পড়তে গেলাম অক্সফোর্ডে, দেখলাম সেখানে ইসলামসহ কোনো ধর্মকেই পছন্দ করা হয় না।
বিজ্ঞান ধর্মের স্থান দখল করে নিয়েছিল। কোনো কিছু যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা না গেলে ধরে নেয়া হতো এর অস্তিত্বই নেই। অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো সীমাবদ্ধ থাকত শুধু সিনেমার পর্দায়। ডারউইন তার আধাসেঁকা, বিবর্তনের থিওরি দিয়ে মানুষ সৃষ্টির তত্ত্ব, তথা ধর্মকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন বলে মনে করা হয়। পড়া হতো তার মতো লোকদের লেখা এবং এরাই ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
ইউরোপের ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে ভীতিকর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। ‘ইনকুইজিশান’ যুগে খ্রিষ্টান যাজকেরা যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন, তা পাশ্চাত্যের মানসে প্রবল প্রভাব রেখে গেছে। পাশ্চাত্য জগৎ সেকুলারিজমের প্রতি এত আগ্রহী হওয়ার কারণ বুঝতে স্পেনে যাওয়া উচিত। সেখানে গেলে দেখা যাবে মধ্যযুগে ধর্মীয় নির্যাতনের উপকরণগুলো। ধর্মযাজকেরা বিজ্ঞানীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন তাদের ‘ধর্মদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে। এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপে মনে করা হতো, সব ধর্মই পশ্চাৎমুখী।
যা হোক, আমার মতো অনেকে ধর্ম থেকে দূরে সরে পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ, ইসলামের শুধু পছন্দসই অংশগুলোকে মেনে চলা। ধর্মের প্রচার ও অনুসরণের মধ্যে বিরাট ফাঁক ছিল। তদুপরি ধর্মের পেছনের দর্শন তুলে ধরার বদলে নিছক আচার অনুষ্ঠানকে দেয়া হতো অতিরিক্ত গুরুত্ব। মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্মত করতে হয় কোনো ধর্মের ব্যাপারে। আল কুরআন অব্যাহত আবেদন রেখেছে মানুষের বুদ্ধিবিবেকের কাছে। এ দিকে, হীন রাজনৈতিক স্বার্থে চলছিল ইসলামের অপব্যবহার।
এমন এক অবস্থায় আমি নাস্তিকে পরিণত না হওয়া একটি অলৌকিক ব্যাপার ছিল। আমি যে নাস্তিক হয়ে যাইনি, এর একমাত্র কারণ হলো শৈশব থেকে আমার ওপর মায়ের জোরালো ধর্মীয় প্রভাব। বিশ্বাসের দৃঢ়তা নয়, মায়ের জন্য ভালোবাসায় আমি একজন মুসলমান রয়ে গেলাম।
অবশ্য আমার ইসলাম ছিল আংশিক। যা আমার ভালো লাগত, ইসলামের শুধু সেটুকুই গ্রহণ করতাম। নামাজ সীমাবদ্ধ ছিল ঈদের দিনের মধ্যে। আর মাঝে মাঝে শুক্রবার বাবা আমাকে মসজিদে নিতে জোরাজুরি করতেন।
সব দিক দিয়ে আমি একজন পাক্কা বাদামি সাহেব হওয়ার লক্ষ্যে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এ জন্য আমার স্কুল ও ভার্সিটির পরিচয় ছিল সহায়ক। সর্বোপরি ছিল অভিজাত ইংরেজ সমাজে আমার গ্রহণযোগ্যতা। এটা অর্জনের জন্য আমাদের বাদামি সাহেবরা তাদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিত। তা হলে কিভাবে আমি ‘বাদামি সাহেব সংস্কৃতি’ বিসর্জন দিয়ে ‘দেশী’ হয়ে গেলাম?
এটা রাতারাতি ঘটে যায়নি।
প্রথমত, আমাদের জেনারেশন উত্তরাধিকার সূত্রে যে হীনম্মন্যতাবোধ পেয়েছিল, তা ক্রমশ বিদায় নিয়েছিল যখন আমি বিশ্বমানের ক্রীড়াবিদ হয়ে গেলাম। দ্বিতীয়ত, দু’টি সংস্কৃতির মাঝখানে বাস করার মতো অনন্য অবস্থানে ছিলাম। দুটোরই সুবিধা ও অসুবিধাগুলো আমার সামনে স্পষ্ট হতে থাকে।
পশ্চিমা সমাজে প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল শক্তিশালী। অপর দিকে আমাদের সমাজে সেগুলো ধসে পড়ছিল। তবে একটি ক্ষেত্রে আমরা উন্নত ছিলাম ও আছি। তা হলো, পারিবারিক জীবন। উপলব্ধি করলাম, পারিবারিক জীবনের বিপর্যয় পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। যাজকদের নিপীড়ন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে গিয়ে ওরা স্রষ্টা ও ধর্ম, উভয় প্রসঙ্গই তাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞান যে পর্যায়েই থাকুক, অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে এই বিজ্ঞানে। তবে কখনো দু’টি প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। এক. আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী? দুই. আমাদের মৃত্যুর পরে কী ঘটে?
এই শূন্যতাই বস্তুবাদী ও ভোগসর্বস্ব কালচারের জন্ম দিয়েছে। এর মনোভাব হলো, ‘পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন। দুনিয়াটা উপভোগের সুযোগ পেলেই গ্রহণ করতে হবে।’ এ জন্য দরকার অর্থ। কিন্তু এ ধরনের কালচার বা সংস্কৃতি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে বাধ্য। এর কারণ দেহ ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক বস্তুগত সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। সেখানে নাগরিকেরা বহু অধিকার ভোগ করে থাকে। অথচ তাদের ৬০ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। তবুও আধুনিক মনোবিজ্ঞানে মানুষের আত্মা অধ্যয়নের বিষয় না হওয়া বিস্ময়কর। সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড সর্বাধিক কল্যাণরাষ্ট্র। তবুও দেশ দুটোতে আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ। মোট কথা, মানুষ কেবল বস্তুগত সমৃদ্ধির ফলে তৃপ্তি পায় না। সে চায় আরো কিছু।
সব ধরনের নৈতিকতার শেকড় ধর্মের মধ্যে প্রোথিত। তাই ধর্মকে উচ্ছেদ করার দরুন অনৈতিকতা বিশেষ করে ’৭০-এর দশক থেকে ত্বরান্বিত হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব সরাসরি পড়েছে পারিবারিক জীবনে। ব্রিটেনে তালাকের হার ৬০ শতাংশ। সেখানে ৩৫ শতাংশের বেশি মা-ই সিঙ্গেল বা একা। পাশ্চাত্যের প্রায় সব দেশে বাড়ছে অপরাধের হার। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আশঙ্কাজনকভাবে বর্ণবিদ্বেষ বাড়ছে। বিজ্ঞান সব সময়ে মানুষের মধ্যে বৈষম্য থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতে চায়। অন্য দিকে শুধু ধর্ম মানুষে মানুষে সাম্যের বাণী প্রচার করে থাকে।
১৯৯১ ও ’৯৭ সালের মধ্যে ইউরোপে পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষ অভিবাসী হয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপের সর্বত্র বর্ণবাদী হামলা ঘটেছে। আফগান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ৪০ লাখের বেশি শরণার্থী ছিল। এখানকার মানুষ এত বেশি দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও তখন বর্ণবাদী উত্তেজনা সৃষ্টি হয়নি।
বিগত আশির দশকে একটার পর একটা ঘটনা ঘটেছে যেগুলো আমাকে পরিচালিত করেছে আল্লাহর দিকে। আল কুরআন বলছে : ‘বুঝতে সক্ষম, এমন মানুষের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ এর একটি হলো ক্রিকেট। আমি যতই ক্রিকেট শিখছিলাম, ততই উপলব্ধি করেছিÑ যাকে আমি ‘ভাগ্য’ বলে গণ্য করতাম, তা আসলে আল্লাহর ইচ্ছা। সময়ের সাথে সাথে এটা আরো স্পষ্ট হয়েছিল। তবে সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস ইস্যু সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রকৃত উপলব্ধি সূচিত হয়নি।
আমার মতো যারা পাশ্চাত্যে ছিল, তাদের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ইসলামবিরোধী মনোভাবের ফলে। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করেছিল। এর জের ধরে চলছিল ইসলামবিরোধী অন্যায় প্রচারণা। তখন আমাদের সামনে খোলা ছিল দু’টি পথ : হয় মোকাবেলা, না হয় পলায়ন। যেহেতু তীব্রভাবে অনুভব করেছি যে, ইসলামের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালানো হচ্ছিল, তাই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিই। তখন উপলব্ধি করি, এ জন্য আমার নেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। কারণ ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান অপ্রতুল। তাই গবেষণা শুরু করলাম, যা আমার জীবনকে সর্বাধিক আলোকিত করেছে। আমি আলী শরিয়তী, মুহাম্মদ আসাদ, ইকবাল প্রমুখ মনীষীর বইগুলো পড়লাম। আর কুরআন অধ্যয়ন তো আছেই।
‘সত্যকে আবিষ্কার করা’ বলতে আমি কী বুঝেছিলাম, তা কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করছি। আল কুরআনে যখনই বিশ্বাসী বা মুমিনদের সম্বোধন করা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে’। অন্য কথায়, একজন মুসলমানের দু’টি মূল দায়িত্ব : একটি আল্লাহর প্রতি, অন্যটি মানুষের প্রতি।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের সবচেয়ে বড় যে প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল, তা হলো, মানুষের ভয় আমার মন থেকে সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল। কুরআন বলছে, জীবন ও মৃত্যু এবং সম্মান ও অপমান আল্লাহর হাতে। এ কথার মাধ্যমে মানুষকে মানুষের কবল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাই কোনো মানুষের কাছে আমাদের মাথানত করার দরকার নেই।
তা ছাড়া এই পার্থিব জীবন অস্থায়ী। এখানে আমরা চিরন্তন জীবনের প্রস্তুতি নিই। ফলে বস্তুবাদ, অহংবোধ প্রভৃতি স্বআরোপিত কারাগার ভেঙে বেরিয়ে এসেছি। এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, পার্থিব আকাক্সক্ষা নির্মূল হয়ে যায় না। তবে সে আক্সক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে বরং তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা চাই।
ইসলামের প্রতি বিশ্বাস আমাকে উন্নত মানুষ হওয়ার পথ দেখিয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে শুধু নিজের জন্য বাঁচার বদলে অনুভব করি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেহেতু আমাকে এত বেশি দিয়েছেন, এর বিনিময়ে তার সে করুণাকে ব্যবহার করব বঞ্চিত মানুষকে সাহায্য করে। ইসলামের মূলনীতির অনুসরণ করে আমি তা করেছি। কিন্তু কালাশনিকভ রাইফেলধারী ধর্মোন্মাদ হইনি।
সহিষ্ণু হয়েছি। দিতে শিখেছি সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সহানুভূতির কারণে। এর কৃতিত্ব আমার নিজের নয়। আল্লাহর ইচ্ছায় এটা সম্ভব হয়েছে। তাই শিখতে পেরেছি ঔদ্ধত্যের পরিবর্তে বিনয়।
সাধারণ মানুষের প্রতি ‘নাক উঁচু’ বাদামি সাহেব না হয়ে আমি বিশ্বাস করি মানব কল্যাণে। আমাদের সমাজে দুর্বল মানুষের প্রতি করা হয়েছে অবিচার। আল কুরআনের ভাষায়, ‘অত্যাচার হত্যার চেয়ে নিকৃষ্ট।’ এখন ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করছি। তা হলো যদি তুমি আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করো, পাবে মনের শান্তি। ঈমানের মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেছি আমার ভেতরের শক্তি। আগে কখনো বুঝিনি যে, এমন এক শক্তি আমার আছে। এটা আমার জীবনে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পাকিস্তানে ইসলামকে মানা হয় পছন্দমতো আংশিক। আল্লাহর প্রতি নিছক ঈমান এবং কিছু আচার প্রথা মেনে চলাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে হতে হবে উত্তম মানুষ। পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশে পাকিস্তানের চেয়ে ঢের বেশি ইসলামি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে নাগরিকদের অধিকার রক্ষা এবং বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। যেসব মানুষকে সবচেয়ে চমৎকার হিসেবে জানি, তাদের কয়েকজন ওই সব দেশে আছেন।
তবে পাশ্চাত্যের যা পছন্দ করি না, তা হলো দ্বিমুখী নীতি, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তারা নিজেদের নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করে; অথচ অন্যান্য দেশের নাগরিকদের গণ্য করে নিম্নশ্রেণীর মানুষ হিসেবে। এই কারণে তৃতীয় বিশ্বে বিষাক্ত বর্জ্য পাঠানো হয়; নিজ দেশে সিগারেটের প্রচার না করে তৃতীয় বিশ্বে দেয়া হয় এর বিজ্ঞাপন; পাশ্চাত্যে নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য এখানে এনে বিক্রি করা হয়।
পাকিস্তানের একটি সঙ্কট হচ্ছে, দু’টি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মেরুকরণ। একপক্ষে পাশ্চাত্যকৃত মহল যারা পাশ্চাত্যের চোখে ইসলামকে দেখে থাকে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান যথেষ্ট নয়। কেউ সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেলেই তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। তারা ইসলামকে খণ্ডিতভাবে মানতে চায়। এর বিপরীত চরম প্রান্তে রয়েছে সেসব লোক, যারা পাশ্চাত্যপন্থী এলিটের ভূমিকার প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং ‘ঈমানের রক্ষাকারী’ হতে গিয়ে এমন অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ির পরিচয় দেয়, যা ইসলামি চেতনার পরিপন্থী।
এই দু’টি চরমপন্থী মহলের মধ্যে যেভাবেই হোক, সংলাপ শুরু করা প্রয়োজন। এ জন্য যা দরকার, তা হলো যাদের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয়, তাদের ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে হবে যথাযথভাবে। তারা দ্বীনদার মুসলিম হয় কি না, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জ্ঞানের অস্ত্রে তাদের সজ্জিত হতে হবে। চরমপন্থার দিকে নাক উঁচু করে থাকলেই সমস্যাটির সমাধান হবে না।
আল কুরআন মুসলমানদের ‘মধ্যপন্থী জাতি’ বলেছে। রাসূল সা:-কে বলা হয়েছিল আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। এরপর মানুষ তা গ্রহণ করল, কী করল না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে বলা হলো তাকে। একজনের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না ইসলামে।
তদুপরি আমাদের বলা হয়েছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তাদের উপাসনালয় এবং তাদের নবী-রাসূল আঃ-দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। এটা লক্ষণীয় যে, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় মুসলিম মিশনারি বা সৈন্যরা যাননি কখনো। মুসলিম বণিকদের অনন্য চারিত্রিক গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়েই সেখানকার জনগণ ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বর্তমানে ইসলামের সবচেয়ে মন্দ ইমেজ প্রচার করছে সেসব দেশ, যারা নিজেদের মনমতো আংশিকভাবে ইসলামকে অনুসরণ করছে। বিশেষ করে যেখানে ধর্মের অপব্যবহার করা হয় জনগণকে অধিকারবঞ্চিত করার জন্য। বাস্তবে ইসলামের মূলনীতিগুলো মেনে চললে সমাজ উদার হতে বাধ্য।
যদি পাকিস্তানের পাশ্চাত্যপন্থী মহল ইসলামকে অধ্যয়ন শুরু করে, তা হলে শুধু ধর্মীয় কোন্দল ও চরমপন্থার মোকাবেলায় সহায়তা করা হবে না, তারা নিজেরা বুঝবেন ইসলাম কত বেশি প্রগতিশীল। তারা ইসলাম সম্পর্কে জানিয়ে পাশ্চাত্যকে সাহায্য করতে পারবেন। সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লস স্বীকার করেছেন, ‘ইসলামের কাছ থেকে পশ্চিমা বিশ্বের শেখার আছে।’ যারা ইসলামকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে, তারাই যদি পাশ্চাত্যের মনোভাব নিজেরা ধারণ করেন এবং ইসলামকে সেকেলে ধর্ম মনে করেন, তা হলে এটা কী করে সম্ভব হবে? ইসলাম বিশ্বজনীন ধর্ম। এ কারণে আমাদের রাসূল সা: গোটা মানব জাতির জন্য রহমত হিসেবে অভিহিত হয়েছেন।
(মাসিক অন্য দিগন্ত থেকে আরব নিউজ-এর সৌজন্যে)