বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১

সিলেটের যানজটের কারণ ও নিরসনে করণীয়

amarsurma.com

ফাহাদ মোহাম্মদ:

কথায় আছে উন্নত বিশ্বে বাড়ি করার আগে রাস্তা করা হয় আর বাংলাদেশে আগে বাড়ি তার পরে রাস্তা। সিলেটের রাস্তাঘাট দেখে মনে হয় ক্ষেতের আইলে আইলে রাস্তা তৈরি হয়েছে। একটা রাস্তাও আধা কিলোমিটার সোজা না
প্রতিটি রাস্তায় অসংখ্য বাক। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে সিলেটের যানজটের বিভিন্ন কারণ। আমি অনেক পত্রিকায় দেখেছি সিলেটের ট্রাফিকজ্যাম নিয়ে অনেকেই অনেক কারণ উল্লেখ করেছেন। আর যারা এসব প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাদের বেশিরভাগ বলেছে ডিজিটাল ট্রাফিক সিগনাল না থাকা ট্রাফিকজ্যামের অন্যতম কারণ। যানজট নিয়ে কাজ করার কারণে আমার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে সিলেট শহরের যানজট সম্পর্কে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তুলনায় সিলেট অনেক ছোট শহর। তবুও এই শহরের মানুষদের যানজটে পরতে হয়। তবে সেটা নিতান্তই কম। যানজট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার কাছে যে কারণ গুলো যানজটের জন্য দায়ী বলে মনে হয়েছে সেগুলোই আমি আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

১। অপ্রশস্ত রাস্তাঃ

আমার মনে হয় সিলেট পৃথিবীর অন্যতম অপরিকল্পিত একটি শহর। সিলেটের প্রায় প্রতিটি রাস্তা অপ্রশস্ত। একটি শহরের রাস্তা যতটা প্রশস্ত হওয়ার দরকার তার ধারেকাছেও সিলেটের রাস্তাঘাট নেই। নগরীর সব থেকে বেশি ট্রাফিকজ্যাম হয় লামাবাজার, সোবহানীঘাট, পেপার পয়েন্ট(লালবাজার-করিমউল্লাহ মার্কেটের সামন-পোস্ট অফিসের সামন), শিবগঞ্জ, মেন্দিবাগ পয়েন্ট, আম্বরখানা। দেখা যাচ্ছে সেই সকল এলাকার রাস্তা অত্যন্ত সরু। গাড়ির তুলনায় রাস্তা কম। একই রাস্তায় রিক্সা ও বাস চলাচল করার নজির পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নাই। একটা রিক্সা যে গতিতে চলবে অন্যান্য যানবাহনও একই গতিতে চলতে বাধ্য কারণ ধীরগতি ও দ্রুতগতির গাড়ির জন্য আলাদা কোনো লেন নেই। যার কারণে শিবগঞ্জ – টিলাগড়, রিকাবিবাজার-শেখঘাট, আম্বরখানা-চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার-নাইওরপুল, লামাবাজার-জিন্দাবাজার, সুবিদবাজার-আম্বরখানার মত ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে দ্রুত গতির গাড়ি চলতে সমস্যা হয়।

২। গাড়ি পার্কিংয়ের অপর্যাপ্ততাঃ

সিলেট শহরের কোথাও পাবলিক পার্কিংয়ের সুবিদা নাই। শুধু মাত্র মার্কেটগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং দিয়ে সিলেটের পার্কিং চাহিদা পুরন করা অসম্ভব। বন্দর বাজারে যে জ্যাম হয় তার অন্যতম কারণ অবৈধ পার্কিং। যারা গাড়ি নিয়ে লাল বাজারে বাজার করতে আসেন তারা গাড়ি রাখার জন্য কোনো পার্কিং সুবিধা না পেয়ে বাজারের সামনেই গাড়ি রেখে দেন। তখন অন্যান্য গাড়ি চলাচল করতে সমস্যা হয়। পার্কিং সুবিধা না থাকায় যে যেখানে পারেন সেখানেই গাড়ি রেখে চলে যান।

৩। গাড়ির স্ট্যান্ড:

সিলেট শহরের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাস্তার মোরে মোরে বিভিন্ন রকম গাড়ির স্ট্যান্ড। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশার ও লেগুনা স্ট্যান্ডগুলো এই যানজটের প্রধান কারণ। সিএনজি অটোরিকশার জন্য নির্ধারিত স্ট্যান্ড না থাকার কারনে এরা রাস্তার মোড়েমোড়ে স্ট্যান্ড করে বসে থেকে যাত্রী উঠানামা করে। সিএনজির জন্য নির্ধারিত স্ট্যান্ড তৈরি করতে পারলে আম্বরখানা ও বন্দরের জ্যাম বেশিরভাগ ভাগ কমে যাবে।

৪। হকারঃ

বন্দর বাজারের সব থেকে বড় সমস্যা হকার। বিকাল হওয়ার সাথে সাথে মহাজনপট্টি থেকে শুরু করে সুরমা পয়েন্ট(কীন ব্রীজের মোর) পর্যন্ত হকাররা রাস্তা দখল করে রাখে। এতে করে যান চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নত হয়। সিলেটের ব্যস্ততম এলাকার প্রায় প্রতিটি ফুটপাথ হকারদের দখলে। এমনকি দোকানের সামনে যদি ফুটপাথ থাকে তাহলে দোকানদার নিজের মনে করে সেটাও দখল করে নেন। এতে পথচারী চলাচলে অসুবিধা হয় এবং তারা রাস্তায় নেমে আসেন। যার ফলে গাড়ির গতি কমে আসে। বন্ধর বাজারে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তার একটা বিঢ়াট অংশ হকারদের দখলে। রাস্তা বন্ধ করে তারা গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। বন্দর থেকে আম্বরখানা পর্যন্ত হকার একটি বড় সমস্যা।

৫। রাস্তার পাশে স্কুল ও হাসপাতালঃ

সিলেটের বেশিরভাগ জ্যামের জন্য দায়ি কয়েকটা প্রতিষ্ঠান। (ক) সোবহানি ঘাটের জ্যামের জন্য ইবনেসিনা হাসপাতাল একক ভাবে দায়ী। তাদের পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা না থাকা, অপরিকল্পিত ভাবে হোটেলকে হাসপাতালে রূপান্তর করে এলাকাজুড়ে ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি করেছে। (খ) স্কলারস হোম সাপ্লাই রোডের ট্রাফিক জ্যামের একমাত্র কারণ। স্কুল শুরু এবং ছুটির সময় অভিভাবকগণ তাদের গাড়ি নিয়ে আসেন। সরু রাস্তার দুই পাশে সাইড করে রাস্তাটা মোটামুটি বন্ধ করে দেন। (গ) আনন্দ নিকেতন এবং রাইজ একাডেমী ঘণ্টা খানেক সময় জ্যামের সৃষ্টি করে সুবিদ বাজার থেক পাঠানটুলা পর্যন্ত। (ঘ) ব্লু বার্ড মিরের ময়দান রোডে সমস্যার সৃষ্টি করে (ঙ) রিকাবী বাজার থেকে মেডিকেল রোড খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। কিন্তু রাস্তার দুই পাশে অগণিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার কোনো রকম পার্কিং সুবিধা না করে গড়ে উঠেছে। যার ফলে রাস্তার দুই পাশে গাড়ি পার্কিং করে রাখার কারণে জ্যামের সৃষ্টি হয়। ব্যস্ততম পয়েন্টের পাশেই সিএনজি ফিলিং স্টেশন, সুবহানি ঘাটের কাচা বাজার যানজটের কারণ।

৬। মোটরসাইকেলঃ

মোটরসাইকেল চালকরাও যানজটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। জিন্দাবাজার, বন্দর, নাইওরপুল, আম্বরখানা, চৌহাট্টা সহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জ্যামের জন্য বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকরা দায়ি। সিলেটে মোটরসাইকেল চালকরা কোনো প্রকার ট্রাফিক সিগনালের তোয়াক্কা করেন না। তাদের যে দিকে খুশি সেদিকেই ছুটে যান। উলটো পথে এসে রাস্তা বন্ধ করে দেয়, জ্যামের মধ্যে কার আগে কে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় দুপাশের রাস্তাই বন্ধ করে দেয়। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ কাজে দ্রুত যাওয়ার জন্য।

৭। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাটঃ

সিলেটের জ্যামের সব থেকে বড় কারণ এই শহরের রাস্তাঘাট ক্ষেতের আইলের মতো তৈরি করা হয়েছে। নগরীর নাইওর পুল, আম্বর খানা, নয়া সড়ক পয়েন্ট দাঁড়িয়ে যদি কেউ লক্ষ্য করেন যে কতটা অপরিকল্পিত ভাবে এই পয়েন্টগুলোতে চত্বর তৈরি করা হয়েছে। রোড ইঞ্জিনিয়ারিং বলে যে একটা কথা আছে সেটা এই পয়েন্টেগুলোতে এসে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।

৮। পার্কিং বিহীন মার্কেটঃ

অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা মার্কেট গুলোর বেশির ভাগের পার্কিং সুবিধা না থাকার কারণে মার্কেটে আশা গাড়িগুলো রাস্তায় রেখে চলে যায়। এতে আম্বর খানা, জিন্দাবাজার, বন্দর এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। অনেক মার্কেট তাদের পার্কিংয়ের স্থানে রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছে। সিটি কর্পোরেশন চাইলে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে পার্কিংয়ের স্থান বৃদ্ধি পাবে।

৯। রিক্সাঃ

এই শহরের যানজটের কারণ রিক্সা। রিক্সার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন প্রয়োগ করা যায় না বলে এরা যেখানে সেখানে দাড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করায়। যদিও রিক্সা বন্ধ করা অমানবিক কাজ হবে, কিন্তু যানজট মুক্ত নগরী গড়তে হলে মূল সড়কগুলোতে রিক্সা চলাচল বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রিক্সার চলাচল সীমিত করা যেতে পারে। আশেপাশের ইউনিয়ন গুলোর রিক্সা যাতে সিটিতে চলতে না পারে তার জন্য সিটির নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রন করতে পারে

আলোচিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো অনেক কারন রয়েছে এই শহরে যানজটের অনেক কারণ রয়েছে। আমি প্রধান প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করেছি। যানজট নিরসনে আমার কিছু পরামর্শ উল্লেখ করলাম।

১। সিলেট শহরে কোনো পাবলিক পরিবহন নাই। যার কারণে সিএনজি অটোরিকশা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে। এর জন্য শহরে সিএনজির পরিমাণ খুব বেশি। পাবলিক বাস সার্ভিসের করতে পারলে শহরে সিএনজির সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এতে শহরে যানজট কম হবে।

২। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস গুলো এসে একদম রাস্তার মোড়ে এসে যাত্রী উঠানামা করায়। এতে সাময়িক সময়ের জন্য মোড়গুলোতে যানজটের সৃষ্টি হয়। লিডিং ইউনিভার্সিটি, শাবি, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের গাড়ি গুলোর জন্য নির্ধারিত কিছু যায়গায় যাত্রী উঠানামা ব্যবস্থা করতে পারলে এই সাময়িক সময়ের যানজট থাকবে না।

৩। নাইওরপুলের -সুবহানিঘাট রোডে এক ইটের মসজিদের সামনে যে পাইপ ডিভাইডার আছে সেটার কারনে গাড়ি চলাচল বাধাগ্রস্থ হয়। রোড ডিভাইডারের পাইপ রাস্তার প্যারালাল করে দিতে হবে। চৌহাট্টা থেকে মীরবক্সটুলা রোডে ডিভাইডার দিলে এই রোডে যানজট কম হবে। (ক) আর এন টাওয়ার হাওয়া পাড়া রাস্তায় ডিভাইভার (খ) চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে আলপাইন রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত ডিভাইডার। এই রাস্তায় গাড়িগুলোর ওভারটেকিংয়ের কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। যদি ক্রসিংয়ে ওভারটেকিং বন্ধ করা যায় তাহলে যানজট হবে না।

৪। আনন্দ নিকেতনের গাড়ি যাতে লন্ডনী রোডের মুখে ইউ-টার্ন না করতে পারে তার জন্য উক্ত ক্রসিং সংকুচিত করা। এবং ইউ-টার্ন নিষেধ ট্রাফিক সাইন লাগানো। স্কলার্শ হোম, গ্রামার স্কুল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা যাতে তারা গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে।

৫। রাস্তায় বেশি বেশি ট্রাফিক সাইন ব্যবহার করা। পার্কিং নিষেধ, ইউ টার্ন নিষেধ, রোড সাইন সহ জাতীয় ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়ালে যতগুলো স্টান্ডার্ড ট্রাফিক সাইন আছে সেগুলোর ব্যবহার করা। সিলেটের রাস্তায় রোড সাইন নেই বললেই চলে। প্রতিটি রাস্তায় যাতে স্টান্ডার্ড ট্রাফিক সাইন ও রোড সাইন সংযুক্ত করা হয় সেই জন্য সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থা নেওয়া।

৬। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সমস্ত শহরকে নজিরদারিতে আনা। সার্বক্ষনিক মনিটরিং করলে রাস্তায় কেউ অবৈধ পার্কিং করবে না। যারা অবৈধ পার্কিং করবে তাদের বিরুদ্ধে ভিডিও মামলা বা ডিজিটাল মামলা করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ড্রাইভাররা অবৈধ পার্কিং করবে না।

৭। ট্রাফিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে জন সচেতনতা সৃষ্টির করা। ট্রাফিক নিয়মকানুন নিয়ে নিয়মিত স্কুল কলেজে ক্লাসের ব্যবস্থা করা। চালকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির করা। পথচারীদের সচেতন করা।

৮। কাছাকাছি দূরত্বে যাতে সবাই পায়ে হেটে যেতে পারে তার জন্য ফুটপাত উন্মুক্ত করা৷ হাটার উপকারিতা সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা। উন্নত বিশ্বে বেশিরভাগ মানু্ষ প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন কিলোমিটার হাটাহাটি করে। আর আমাদের জনগণ জিন্দাবাজার থেকে চৌহাট্টা আসতে রিক্সা খুঁজে।

৯। যেহেতু রিক্সার অনুমোদন সিটি কর্পোরেশন দেয় তাই রিক্সা নিয়ন্ত্রনের জন্য সিটির নিজস্ব বাহিনীর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি৷ এই বাহিনী পুলিশের পাশাপাশি রাস্তায় রিক্সা নিয়ন্ত্রনে কাজ করবে।

লেখক: পুলিশ সার্জেন্ট, ট্রাফিক বিভাগ, এসএমপি, সিলেট।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com