মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
সরেজমিন হরিপুর: প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অসহায় নারীকে হত্যার অভিযোগ, আহত একজনের মৃত্যু

সরেজমিন হরিপুর: প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অসহায় নারীকে হত্যার অভিযোগ, আহত একজনের মৃত্যু

amarsurma.com

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার, হরিপুর (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) থেকে ফিরে:

গ্রাম্য আদিপত্য বিস্তারের বলি হলেন বয়োবৃদ্ধ আনোয়ারা বেগম। আর তার মৃত্যুর ঘটনায় নানা ধরণের রহস্যের জন্ম দিয়েছে। গ্রামের নিরপেক্ষ ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় হত্যাকা-ের ঘটনাটি পুরোপুরিই পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে মনে করেন তারা। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের ১৯ জন আহত ও গ্রেফতার করা হয়েছে ৯ জনকে। এছাড়া গুরুতর আহত উস্তার আলীর ছেলে মুছা মিয়া (৩০) ঢাকার চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যায় মারা যায়। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মৃতের সংখ্যা দাড়ালো ২ জন।
থানা পুলিশ ও গ্রামবাসি জানান, সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের নতুন ও পুরাতন হাটির মধ্যবর্তী খেলার মাঠে সোমবার এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গতকাল সরেজমিন গ্রামে গেলে পাওয়া যায় এ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের বক্তব্য।
খেলার মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমের পতিত গো-চারণ রকম ভূমি নিয়ে গ্রামের দুই প্রভাবশালী আব্দুর রহমান ফকির ও হাজী তালেব আলীর গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। এ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে। এলাকাবাসি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কয়েকবার বিচার-সালিশের মাধ্যমে সমাধান করে দিলেও বিভিন্ন ইস্যুতে আবারও ঝগড়া শুরু হয়। হরিপুর গ্রামবাসির এহেন কর্মকা-ে এলাকাবাসি বিচার-সালিশ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। সাম্প্রতিককালে সেখানে গাছ লাগানো ও বাড়ি বানানোকে কেন্দ্র করে আবারও গ্রামে হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রোববার রাত থেকেই সংঘর্ষের প্রস্তুতি চলছিল। ফলে সোমবার দুপুরেই তা বড় ধরণের সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ ঘটনায় একজন নিহত হলেও বিষয়টি রহস্যজনক মনে করেন এলাকাবাসি। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেকেই আহত হন এবং কয়েকজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে উভয়পক্ষের ৯ জনকে। গ্রেফতারকৃতরা হল মৃত সাজিদ উল্লাহর ছেলে সামাদ আলী, মনির উদ্দিনের ছেলে রুহুল আমিন, মৃত আবারক আলীর ছেলে ফয়জুর আলী, সমসর আলীর ছেলে সৈয়দ মিয়া, মৃত বাক্কা মিয়ার ছেলে কুতুব উদ্দিন, মৃত সমুজ আলীর ছেলে হেলাল আহমদ, মৃত আবারক আলীর ছেলে জুনাব আলী, হাজী মোঃ আব্দুর রহমানের ছেলে সোহেল আহমদ, আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে দুলাল মিয়া ওরফে আমিনুল ইসলাম।
হঠাৎ ফোন:
হরিপুর গ্রামের মৃত ফয়জুর রহমান ৩টি বিয়ে করেছেন। নিহত আনোয়ারা বেগম (৬০) তার তৃতীয় স্ত্রী। সোমবার হঠাৎ তার স্বামীর প্রথমপক্ষের সন্তান নূর উদ্দিনের স্ত্রী (নিহতের সৎ ছেলে) মোবাইলে তাকে তাড়াতাড়ি নতুন হাটিতে আসতে বলেন। তাই তিনি নতুন কাপড় পড়ে আসেন। রাস্তায় অনেকের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি উত্তর দিলেন, ‘নূর উদ্দিনের বউ কল দিছে তাড়াতাড়ি নয়াহাটিতে যাইতে’। ফলে অনেকেই এই ফোনকে হত্যাকা-ের সূত্র বলে মনে করেন।
পুরুষ শূণ্য গ্রাম:
সংঘর্ষের পর থেকে আহতরা সুনামগঞ্জ ও সিলেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং গুরুতর আহত একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বুধবার চিকিৎসাধীন ঢাকায় মুছা নামে একজন মারা যায়। আর অনেকেই গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে নতুন ও পুরাতন হাটিতে এখন পুরুষ শূণ্য।
এদিকে হরিপুর গ্রামের সংঘর্ষের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গতকাল ঘটনাস্থলে গেলে নিহত আনোয়ারা বেগমের আত্মীয়-স্বজনরা জানান, আমাদের বিরোধীপক্ষ হাজী তালেব আলীরা নানাভাবে নির্যাতন করে আসছে। প্রায় একমাস আগেও আমাদের একজনকে মসজিদের ভেতরে আক্রমণ করে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। আমাদের লোকজন ভয়ে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে জীবদাড়া থেকে লোক এনে প্রশাসনের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসায় পাঠানো হয়। এ নিয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এরপর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই মারামারি হতো উভয়পক্ষের মধ্যে। এরই জের ধরে গতকাল সোমবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে নিহতের বিরোধীপক্ষ হাজী তালেব আলীর লোকজন জানান, খেলার মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে পতিত গো-চারণ ভূমি রয়েছে। জায়গাটি গ্রামের নতুন ও পুরাতন হাটির সবাই ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আব্দুর রহমান ফকিরের গোষ্ঠীর লোকজন নানাভাবে দখল করার পায়তারা করে আসছে। আমাদের পক্ষের কেউ সেখানে মাছ ধরতে বা গরু ছড়াতে গেলে মারধর করে। তারা ঘর তুলে ও গাছ লাগিয়ে অধিকাংশ জায়গা দখল করে নেয়। এ নিয়ে অনেকবার মারামারি হওয়ার পর এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং প্রশাসনের লোকজন বিচার-সালিশের মাধ্যমে সমঝোত করে দেন এবং একটি লিখিত কাগজে সবাই স্বাক্ষর করলেও ফকিরের লোকজন তাতে স্বাক্ষর করেনি। অন্যান্যরা জায়গার দখল ছাড়লেও তারা দখল ছাড়েনি। এ জায়গায় লাগানো গাছ এখনও রয়েছে। এর জের ধরেই সোমবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তারা আরও জানান, নিহত মহিলাটি অত্যন্ত সহজ-সরল ছিল,মানুষের বাড়িতে কাজ করে চলত। তাকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সংঘর্ষ হয়েছে মাঠে আর মহিলাটি মারা গেছে গাছ বাগানে জানিয়ে তারা বলেন, মধ্যখানে নিহতের পক্ষের লোকজন থাকায় তাদের ডিঙ্গিয়ে গিয়ে তাকে মারার কোন সুযোগ ছিলনা। তাছাড়া মানুষের মুখে মুখে শুনতে পাচ্ছি যে, মহিলাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে আনোয়ারা হত্যাকা-?
হরিপুর গ্রামের মৃত ফয়জুর রহমানের তৃতীয় স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৬০)-এর হত্যাকা-টি রহস্যজনক কি না, এ নিয়ে চলছে নানা সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের গোয়েন্দা বিভাগের নিরপেক্ষ তদন্তের ফলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে মনে করেন এলাকাবাসি। তবে এ মুহূর্তে বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যার কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রশ্নগুলো হল সংঘর্ষ হল এক জায়গায়, আর আনোয়ারা বেগম নিহত হলেন অন্য জায়গায়। এর মধ্যখানে নিহতের পক্ষের লোকজন থাকার পরও প্রতিপক্ষরা কিভাবে প্রায় ৫০/৬০ হাত দূরে এসে তাকে হত্যা করলো? কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, মহিলার বুকে একটি টেঁটাবিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে তার শরীরে বেশ কয়েকটি রামদার কোপ, ফলার ঘাসহ একাধিক জখম কে করলো? মহিলাটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন সড়কে, কে বা কারা তাকে বাড়িতে নিয়ে গেলো এবং পুলিশ আসার পর পুনরায় বাড়ি থেকে সড়কে পুলিশের হাতে দেয়া হলো? রহস্যজনক এ ঘটনায় এসব ছাড়াও আরও অনেক প্রশ্ন গ্রামের নিরপেক্ষজন ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। সবার একটিই প্রশ্ন, কারও স্বার্থে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে আনোয়ারা বেগমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে না তো?
হত্যাকা- নিয়ে নানা রহস্য রয়েছে। তার মতে, যে জায়গাতে সংঘর্ষ হয়েছে, সেই জায়গার অনতিদূরে মহিলাটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান। তিনি আরও বলেন, খেলার মাঠে সংঘর্ষ চলছিল, পূর্বপার্শ্বে নিহত মহিলার বিরোধীপক্ষ, পশ্চিমপার্শ্বে তার পক্ষের লোকজন আর তাদের ৫০/৬০ হাত দূরে পশ্চিম অংশে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। অর্থ্যাৎ নিহতের পক্ষের লোকজনকে ডিঙ্গিয়ে বিরোধীপক্ষের লোকজন এখানে আসার সুযোগ ছিল না। তার মতে, দূর থেকে দেখেছি মহিলার বুকে টেঁটাবিদ্ধ, এটি ধরে ধরে নিয়ে তিনি হাটছেন আর বাঁচার জন্য চেষ্টাও করেছেন। এ সময় তার শরীর থেকে টেঁটা খুলতে একজন চেষ্টাও করেছেন। পরে শুনতে পেলাম যে, ঐ নারীর শরীরে রামদার একাধিক কোপ ও আঘাত রয়েছে। অথচ এ সময় এখানে কোন সংঘর্ষ হয়নি। সম্ভবত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই ঐ নারীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাথারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান জানান, হরিপুর গ্রামের দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠী প্রধান ব্যক্তি হাজী আব্দুর রহমান ফকির ও হাজী তালেব আলীর মধ্যে আদিপত্যগত দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে দ্বন্দ্ব সমাধান করে দিয়েছি। গ্রামের মধ্যে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুলের ফান্ড এবং পতিত জায়গা নিয়ে মূলত তাদের মধ্যে বিরোধ। এছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় প্রশাসন একাধিকবার দ্বন্দ্ব সমাধান করে দিলেও পুনরায় তাদের মধ্যে আদিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ আসাদুজ্জামান হাওয়াদার জানান, হরিপুর গ্রামের ঘটনায় নিহতের পক্ষের লোকজন একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-০১, তারিখ-০৪/০৯/২০১৯ ইং। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকেই পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে, বর্তমানে গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।

amarsurma.com

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com