রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৩ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম:
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম (৭২) ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি.. ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল সকাল ১১টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে তার লাশ গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে নেয়া হবে না। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদকে। নাসিম জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে। গত ১ জুন করোনা উপসর্গ নিয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হলে ফলাফল পজিটিভ আসে।
হাসপাতালে ভর্তির চার দিন আগে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ আসে তার। এরপর হাসপাতালে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আইসিইউ থেকে কেবিনে নেয়ার দিন গত ৫ জুন শুক্রবার ভোরে তার ব্রেন স্ট্রোক হয়। সেদিনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রাজিউল হকের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার হয়। এরপর থেকে আইসিইউতে ডিপ কোমায় ছিলেন নাসিম। এ অবস্থায় পরপর তিনটি করোনা টেস্টে ফলাফল নেগেটিভ আসে তার। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর নেয়ার প্রস্তুতিও চালানো হয় পরিবারের পক্ষ থেকে তবে নাসিমের অবস্থা সংকটাপন্ন থাকার কারণে বিদেশ নেয়া সম্ভব হয়নি। গতকাল তিনি মারা যান।
মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকারসহ মন্ত্রী এমপিরা। গত এক শোক বার্তায় প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে হারালো। আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন নির্ভীক যোদ্ধা। তিনি জনগণের প্রিয় নেতা ছিলেন বলেই পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশর জাতীয় রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মোহাম্মদ নাসিমের নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন দেশপ্রেমিক ও জনমানুষের নেতাকে হারাল। আমি হারালাম একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন:
আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা অন্যতম জাতীয় নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত বাংলাদেশ সরকারে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের মায়ের নাম মোসাম্মৎ আমিনা খাতুন, যিনি আমেনা মনসুর হিসেবেই পরিচিত। পারিবারিক জীবনে নাসিম বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক। তার স্ত্রীর নাম লায়লা আরজুমান্দ। মোহাম্মদ নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৪-১৮ সরকারে নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ১৪ দলীয় মহাজোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ছাত্রজীবনের প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। পরে অল্প কিছু দিন ছাত্রলীগের রাজনীতিও করেন। ছাত্ররাজনীতি ছাড়ার পরে যুবলীগের রাজনীতি করলেও ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নাসিম। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনৈতিক জীবনে রাজপথে সবসময়ই সক্রিয় ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন সময় নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। রোষানলের শিকার হয়েছিলেন ১/১১ সরকারেরও। সে সময় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে কাটান তিনি। পাশাপাশি এই সময়ে চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বিএনপির শোক
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে বিএনপি। বর্ষিয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে গতকাল বিএনপি মহাসচিব গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। উত্তরার নিজ বাসভবন থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মোহাম্মদ নাসিম একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা, যিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছিলেন। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।