শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন
মুহাম্মাদ আবদুল হামিদ:
যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষকে মাথা নিচুঁ করে থাকতে হয়েছে বহিরাগত দখলদার শাসকদের অত্যাচারে। দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতন, শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য জীবন-মরণ বাজি রেখে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে এদেশের মানুষ। বুকের তরতাজা রক্ত দিয়ে বীরবাঙ্গালি পর্যায়ক্রমে বৃটিশকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার সম্মানকে বিশে^র দরবারে সমুজ্জল করেছে। পাক হানাদার বাহিনীর নাগপাশ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। আমরা পেয়েছি একটি গৌরবময় ইতিহাস। একটি লাল-সবুজ পতাকা। একটি মানচিত্র। একটি স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে যে নৃশংসতা, পাশবিকতা ও গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা পাওয়া দুর্লভ। নিহত ও শাহাদাতরবণ করেছিলেন ৩০ লাখ নিরীহ মানুষ। ধর্ষিতা হয়েছিলেন দুই লাখেরও অধিক নারী। প্রায় এক কোটি বাঙ্গালিকে প্রতিবেশী দেশে নির্বাসিত হতে হয়েছিল আর দেশের মধ্যেই প্রায় তিন কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় ত্যাগ, অবর্ণনীয় দুঃখ, লাখো শহীদের রক্ত, অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা।
যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকহানাদার বাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল। নিরস্ত্র নিরপরাধ অগণিত মানুষকে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। এমনি একটি গণহত্যা চালিয়েছিল একাত্তর সালের ৩১ আগস্ট শ্রীরামসি বাজারে। বিভিন্ন তথ্যমাধ্যম থেকে এ গণহত্যায় শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার কথা জানা যায়। তবে আম্মু বলেছেন, নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশী হবে। নরপিশাচরা পরপর তিন দফা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে যাবার সময় আগুনে ছারখার করে দিয়েছিল শ্রীরামসি বাজার, গ্রামের বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা। এই নির্মম গণহত্যার ক্ষত আজও শ্রীরামসিবাসী কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বয়োবৃদ্ধরা এখনো সেই স্মৃতি স্মরণ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। একাত্তরের সেই নির্মমতার বর্ণনাটি আম্মুর কাছ থেকে অনেকবার শোনেছি। এটি আমাদের পারিবারিক জীবন ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং দেশ ও জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আম্মু চোখের পানিতে মুছতে মুছতে এই নির্মম কাহিনী বর্ণনা করেন।
আমার জন্মের অনেক আগের কথা। আমাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানাধীন শ্রীরামসি বাজারের পার্শবর্তি দিঘীরপার গ্রামে। ধন-ধন্য পুষ্পভরা সুজলা-সুফলা-শ্যমলা এ গ্রাম ও পার্শবর্তী গ্রামগুলো ছিল প্রবাসী ধনাঢ্য, সম্পদশালী, গুণীজনের আবাসস্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদাররা এ গ্রামগুলোতে চালিয়েছিল নির্বিচার গণহত্যা।
এ গণহত্যায় হানাদার বাহিনী শ্রীরামসি বাজার ইশকুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, ইশকুলের আরেক শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হাই, তহশিলদার, পোস্ট মাস্টারসহ দফায় দফায় ব্রাশফায়ার করে এলাকার চিিহ্নত বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গকে হত্যা করেছিলো। আমার চাচা ‘এখলাছুর রহমান’ ও নানা ‘আইয়ূব মিয়া’ (আম্মুর মামা) হানাদার বাহিনীর গুলিতে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। দাদা ও আরেক চাচাকে ইশকুলের একটি কক্ষে নিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলা হয়েছিল। শ্রীরামসি বাজার মসজিদের ইমাম হওয়ার কারণে চাচা আর বৃদ্ধ হওয়ার কারণে দাদা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। কিন্তু ‘এখলাছুর রহমান’ কোন অবস্থাতেই রক্ষা পাননি। কেননা তিনি ছিলেন লন্ডন প্রবাসী, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সৎসাহসী।
এলাকার বাছাই করা মানুষগুলোকে আটকে রেখে অন্যান্য ছেলে-মেয়ে ও বৃদ্ধদেরকে বলেছিল এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। ঐদিন আমার এক ফুফু ইন্তেকাল করেছিলেন। তার লাশ দাফনের সুযোগ হয়নি। আম্মু বলেন, “প্রাণভয়ে আমরা লাশ ঘরে রেখেই নরপিশাচদের নির্দেশ মত এলাকার নিরীহ জনসাধারণসহ নিরুপায় হয়ে বাসস্থানের মায়া ত্যাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। কিছু দূর যেতেই ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনতে পাই। এ সময় গ্রামের বুদ্ধিজীবী, চাকুরিজীবী, তরুণ ও ছাত্রসহ শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। বর্ষাকালীন তীব্র বন্যা ছিল তখন। হানাদাররা লাশ বন্যার পানিতে ফেলে দেয়। রক্তে লাল হয়ে ওঠে হাওরের স্বচ্ছ পানি। দাফনের কেউ ছিল না। সবাই থৈথৈ পানিতে সাতার কাটতে কাটতে বিশাল হাওর অতিক্রম করে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।”
আম্মু আরো বলেন, “আমরা শ্রীরামসি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে বিশ্বনাথ এলকার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এক সপ্তাহ অবস্থান করছিলাম, সেখান থেকে হানাদার বাহিনী কর্তৃক ১ সেপ্টেম্বর (১৯৭১ সাল) শ্রীরামসি বাজার ও পার্শবর্তী গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার আগুনের কুন্ডলী দেখা যাচ্ছিল।”
এলাকায় কোন মানুষ ছিল না। পানিতে ভেসে ওঠা লাশ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল শেয়াল কুকুর আর শকুনেরা। পঁচা মানুষের গন্ধে দূর্গন্ধময় হয়ে যায় এলাকা। এক সপ্তাহ পর স্বজনরা ফিরে এসে চোখের জলে জীবজন্তু খাওয়া গলিত পঁচা লাশই এক একটি গর্তে চার/পাঁচজন করে বিনা কাফনে দাফন করেন। অনেকের লাশ খোঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষের রক্ত-বর্জ্যে হাওরের পানি বিষাক্ত হয়ে যায়। মাছ মরে ভেসে ওঠে। দীর্ঘদিন আশপাশের হাওর, পুকুরের মাছ খেতে পারেননি স্থানীরা। বন্যার পানি কমার পর ফসলের জমিতে অনেক মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যেত। এ ঘটনায় শোকে কাতর স্বজনহারা গ্রামবাসী প্রতিশোধপরায়ন হয়ে শপথ নেন স্বাধীনতার। কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে দেশ পুরোপুরি স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এই নির্মম কাহিনীর কথা আমার বাবা ‘মরহুম দানাউর রহমান’ প্রায়ই কেঁদে কেঁদে বলতেন। স্মৃতি স্মরণ করে হু হু করে কাঁদতেন, নিরবে চোখের জল ফেলতেন। ফ্যাকাশে হয়ে যেত বাবার চেহারা। নির্মমতার এই স্মৃতি তাঁকে নিরব-নিথর করে দিত। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলতেন তিনি।
আমাদের অত্মীয় স্বজনদের অনেকেই এই গণহত্যায় শাহাদাতবরণ করেছিলেন। সীমাহীন নির্যাতন ও লাঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। শুধু আমরা নয়; মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মানুষের অবস্থা ছিল এমনমই। এসব নির্মমতার বর্ণনা থেকে অনুমাণ করা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের মানুষ কী পরিমাণ জুলুম-নির্যাতন, দঃখ-দূর্দশা, লাঞ্ছনা-অপমান সহ্য করেছিলেন। কত মায়ের বুক খালি হয়েছিল। কত বোন তার ভাইকে হারিয়েছিলে, কত স্ত্রী তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে হারিয়েছিল। মোটকথা মানুষের দুঃখ-দূর্দশা ছিল সীমাহীন। কোটি কোটি মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। উদ্বিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছিল দখলদার শাসকদের অত্যাচার, দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতন ও শাসন-শোষণ থেকে।
শিক্ষক: জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।