শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৭ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেক্স : দরিদ্র মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যারিটি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তীতুল্য আবদুস সাত্তার ইদি ৮৮ বছর বয়সে গত শুক্রবার পাকিস্তানে নিজ শহর করাচীতে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি পাকিস্তানে গড়ে তুলেছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। তার নামে প্রতিষ্ঠিত ইদি ফাউন্ডেশন এখন বিশাল এক সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানজুড়ে শত শত বিনামূল্যের নার্সিং হোম, বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, এতিমখানা, নারীদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনকেন্দ্র, বৃদ্ধনিবাস, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র, মাদক নিরাময় কেন্দ্র, স্কুল ও হাসপাতাল পরিচালনা করে থাকে। সংস্থাটি কবরস্থান এবং মর্গগুলোও পরিচালনা করে থাকে। গত কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, সন্ত্রাসীরা বা তালেবানরা সরকারি কোনো অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি দেখলে বোমা বা গুলি চালালেও ইদি ফাউন্ডেশনের কোনো অ্যাম্বুলেন্সে কোনো হামলা চালায় না। পাকিস্তানের কোনো সন্ত্রাসী হামলার স্থানে সর্বপ্রথম যে অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পাবেন সেটা হলো ইদি ফাউন্ডেশনের। সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে দাঙ্গা পরিস্থিতির ভেতরেও ইদির সদস্যরা বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতার সঙ্গে মানুষের লাশ সংগ্রহ করে। তার ইন্তেকালে শুধু সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান নয়, বরং সমাজের সকল পেশার ও মতের লোকজন এবং সব রাজনৈতিক দল শোক প্রকাশ করেছে। ইদির পুত্র জানিয়েছেন, তাঁর বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী, যে পোশাক তিনি সর্বদা পরে থাকতেন সেই পোশাকেই তাঁকে দাফন করা হবে। তিনি তাঁর অঙ্গ দান করে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে সচল নয়। তাই শুধুমাত্র কর্নিয়া দান করা হয়েছে। কোনোদিন স্কুলের গ-ি না পেরুলেও ২০০৬ সালে করাচির ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে তাকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়াও ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে ডিলিট দেয়। অবসর এমনিতেই খুব কম পেতেন তিনি, তবে যাও পেতেন তখন তার নেশা ছিল বই পড়া। ভারতের গুজরাটের এক বণিক পরিবারের সন্তান ইদি ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। কিন্তু নিজের অসুস্থ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা’র দেখাশোনা করতে রাষ্ট্র কীভাবে ব্যর্থ হল, তা দেখে তিনি জীবনভর সমাজসেবা করার সিদ্ধান্ত নেন। করাচির জোদিয়া বাজারের কাছে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেন তিনি। প্রথমেই মিথাদারের কাছাকাছি সারফা বাজার থেকে কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে আসেন এবং ১১টি মোবাইল ডিসপেনসারি খোলেন শহরের ফুটপাতে। আজ সেই একই স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইদি সেন্টার। অন্যের কষ্ট লাঘবে ইদির নেয়া ছোট্ট একটি মানবহিতৈষী কাজ তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় বিশাল এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সঙ্গে এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যারিটি নেটওয়ার্ক হয়ে যায় এই উদ্যোগ, যার নাম ইদি ফাউন্ডেশন। ১৯৫১ সালে তিনি প্রথম ক্লিনিক খোলেন। কখনো কখনো রাষ্ট্র যেসব সেবা দিতে ব্যর্থ হয় সেগুলোও দিয়ে থাকে এই ইদি ফাউন্ডেশন। তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং অনেকেই তাকে সাক্ষাৎ দেবদূত জ্ঞান করত। ২০১৪ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইদি জানিয়েছিলেন, সাধারণ জীবনযাপন, সততা, কঠোর পরিশ্রম ও সময়ানুবর্তিতা তার কাজের মূল বিষয়। তিনি বলেছিলেন, অন্যদের সেবা করা প্রত্যেকের কর্তব্য, মানুষের জীবনের অর্থও তাই। বেশি বেশি মানুষ এমনভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সাধারণ জীবনযাপনের জন্যও তিনি পরিচিত ছিলেন। জানামতে, তার মাত্র দুইপ্রস্থ পোশাক ছিল। ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের পাশে একটি ছোট ও প্রায় আসবাবপত্রহীন ঘরে তিনি বসবাস করতেন। ২০১৩ সালে তার কিডনি অকেজো হয়ে যায়। বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের সরকারি কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। বিলকিস বেগম নামের এক নারীকে ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেন ইদি। দু’জনে মিলেই শুরু করেছিলেন তাদের সকল কাজ। যুদ্ধ সংঘাতময় অঞ্চলে অনেক সময় নিজেও গাড়ি নিয়ে ছুটে গেছেন আহত নিহতদের সংগ্রহে। আহতদের যতটা সম্ভব দ্রুত হাসপাতালে আনার জন্য অনেক সময় নিজেও গাড়ি চালিয়েছেন। তবে অধিকাংশ সময়ই তিনি গাড়ির সামনে চালকের ঠিক পাশের চেয়ারটিতে কালো পাগড়ি পরিধান করে বসে থাকতেন এবং নিজে বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করতেন। একেবারে জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত তিনি একই কাজ করে গেছেন, একদিনের জন্যও অলসতাকে কাছে আসতে দেননি। ২০০৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তৎকালীন করাচির কিছু অংশে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। সেসময় ইদি এবং তার স্ত্রী বিলকিস শিশু এবং নারীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ কুড়িয়ে সংগ্রহ করেছিলেন। স্ত্রী বিলকিস নারীদের শরীর ধোয়ার কাজটি করেন এবং বাকিদের ধোয়ান ইদি নিজে। ওই ঘটনার পর ইদির বক্তব্য অনুযায়ী, ক্ষত বিক্ষত, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহগুলো দেখে আমার হৃদয় কঠিন হয়ে যায় সেদিন। মানবতার কাছে এবং ধর্মের কাছে সেদিন থেকেই আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলাম। কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের দুঃস্থ শিশুদের সহযোগিতা করে আসছে ইদি ফাউন্ডেশন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পাকিস্তানে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে খুব কড়াকড়ি হয়ে থাকে। এর মধ্যেও যেসব সন্তান তাদের পিতা-মাতা না থাকায় নাগরিকত্ব কার্ড তৈরি করতে পারে না, তাদের পিতা হয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ারও বন্দোবস্ত করতেন তিনি। এই কাজের জন্য সিন্ধুর উচ্চ আদালত তাকে একবার তলবও করেছিলেন। গোটা জীবন মানুষের জন্য করতে গিয়ে বিভিন্ন বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে তাকে। কখনও পচা লাশের মাঝে আবার কখনও বোমা হামলার মাঝে ক্ষতিকারক গ্যাস মুখোমুখি করে নিরপরাধ মানুষকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন তিনি। আজও তাই শত্রু-মিত্র, ভালো-মন্দ, ইতিবাচক-নেতিবাচক সবার কাছেই আবদুস সাত্তার ইদি এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম। যার আলোয় আলোকিত বহু মানুষ। র্যামন ম্যাগসাসে পুরস্কারজয়ী আবদুস সাত্তার ইদি পাকিস্তানের সুবিখ্যাত মানবতাবাদী এবং ইদি ফাউন্ডেশনের প্রধান। এই ফাউন্ডেশন পাকিস্তান ছাড়াও বিশ্বের অন্য দেশেও সেবামূলক কাজ করে। আবদুস সাত্তার ইদির স্ত্রী বিলকিস ইদি বিলকিস ইদি ফাউন্ডেশনের প্রধান। ১৯৮৬-তে ইদি দম্পতিকে যুগ্মভাবে রামন ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, কোনওক্রমে পাকিস্তানে ঢুকে পড়া ভারতের মূক ও বধির তরুণী গীতা এই ইদি ফাউন্ডেশনের আশ্রয়েই ছিল। ২০০৩-০৪ সালে লাহোরে গীতাকে উদ্ধার করে পাকিস্তান বর্ডার গার্ডস। তারা গীতাকে ইদি অনাথ আশ্রমে নিয়ে যায়। এরপর গীতার দেখভাল করে ইদি ফাউন্ডেশন এবং বিলকিস ইদি। গত বছরে গীতাকে ভারতে ফেরানো হয়। সেই সময় ইদি ফাউন্ডেশনের সদস্যরাও ভারতে এসেছিলেন। গীতাকে এক দশকেরও বেশি সময় দেখভালের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইদি ফাউন্ডেশনকে এক কোটি রুপী দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেবামূলক কাজের জন্য ওই অর্থ গ্রহণ করতে রাজি হননি আবদুস সাত্তার ইদি।