শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার কথা, ‘আমি কী মুক্তিযোদ্ধা না!’

হাবিব সরোয়ার আজাদ: ‘৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের প্রথম থানায় তৎকালীন সহকারি দারোগা বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সদস্য জীবদ্দশায় ৯০ কোটায় পা রাখলেও পুলিশ বিভাগের অবহেলার কারণেই গত ৪৫ বছর কেটে গেলেও উনার ভাগ্যে জুটেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। নিজের মুক্তিযোদ্ধের স্বীকৃতি হাতে না পেলে কী হবে, বার্ধক্যে কাবু হয়ে পড়ে থাকা এ জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে প্রায়ই সুকুমার মুৎসুদ্দি রাঙামাটির রিজার্ভ বাজারের শহীদ স্মৃতিফলকে ছুঁটে যান আত্মার টানে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের টানে। স্মৃতিফলকে রাঙামাটির প্রথম শহীদ হিসাবে সুকুমার মুৎসুদ্দির ¯েœহাসপদ শহীদ ছোট ভাই সুনীল কুমার মুৎসুদ্দির নামটিও রয়েছে প্রথমদিকে। এ ফলকেই রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের নামসহ আরো অনেক বীরসেনানীর নাম।
দেশ স্বাধীনের পর ওই ওসি ৪৫ বছর ধরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বারংবার ধর্না দিয়েও বহু আবেদন নিবেদন করে আসার পর আজো হাতে মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র সুকুমার বাবুর। ৭৩ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় প্রাপ্য সম্মান ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে সরকারের দায়িত্বশীলদের দরজায় বার বার কড়া নাড়লেও শহীদ পরিবারের সদস্য ও বীরমুক্তিযোদ্ধা পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পৌর শহরের শান্তিনগর আসাম বস্তির প্রয়াত দিগাম্বর মুৎসুদ্দির জ্যেষ্ঠ ছেলে ৯০ বছর বয়সী সুকুমার মুৎসুদ্দির একটি সনদ প্রাপ্তির জন্য প্রশাসনিক হয়রানীর মুখে পড়তে হয়েছে বহুবার।
সম্প্রতি রাঙামাটি গেলে পার্বত্য অঞ্চলের ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ ও সেখানকার বীর সন্তানদের রণাঙ্গনে ভূমিকার বীরত্বগাঁথা ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমিকে পাক বাহিনীর কবল থেকে উদ্ধারে পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে পাকবাহিনীর হাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সে সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধিন বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদেরই একজন চট্টগ্রামের রাঙামাটি পার্বত্য জেলার পৌর শহরের শান্তিনগর আসামবস্তির বাসিন্দা স্বর্গীয় দিগাম্বর মুৎসুদ্দির ৯০ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ ছেলে (অব:) পুলিশ কর্মকর্তা সুকুমার মুৎসুদ্দির কথা।
৭১’র মুক্তিযুদ্ধে সুকুমার মুৎসুদ্দির যেমন ছিলেন সমরের একজন সক্রিয় বীরযোদ্ধা তেমনি আওয়ামীলীগ পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে দেশ মাতৃকার টানে তার আপন সহোদর ছোট ভাই রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক নববিবাহিত যুবক সুনীল কুমার মুৎসুদ্দি ৫ মাসের গর্ভবর্তী স্ত্রীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলে মুক্তিযোদ্ধাগণের খাবার সরবরাহ করতে গিয়েই রাঙামাটির কর্ণফুলী নদীতে সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধারগণের সাথে সেই সময় পাকসেনাদের বুলেটে প্রথম শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐহিত্যে যে সকল বীর সন্তানদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাদের ব্যাপারে জানতে গেলে রাঙ্গামাটি জেলা শহরের একাধিক মুক্তিযোদ্ধাগণের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পৌর শহরের শান্তিনগর আসাম বস্তিতে গেলে পাড়ার লোকজন এ প্রতিবেদকে নিয়ে যান (অব.) পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ পরিবারের সদস্য বয়োবৃদ্ধ মুৎসুদ্দির বাবুর মাটির তৈরি বসতভিটায়।
মের প্রথম সপ্তাহের এক সকালে কর্ণফুলীর কাপ্তাই লেকের তীর ঘেষা শান্তিনগর আসাম বস্তির মাটির তৈরি বসতভিটায় বসে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে (অব) পুলিশ কর্মকর্তা বাবু সুকুমার মুৎসুদ্দি বীর সন্তানের জন্ম, শৈশব, পুলিশের চাকুরী জীবন ও ৭১’র রনাঙ্গণে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা হৃদয়ে আবেগে ক্ষোভে লুকিয়ে রাখা মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ত্যাগের কথা।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন: চট্টগ্রামের রাউজান থানার পশ্চিম আন্দার মানিক গ্রামের প্রয়াত দিগাম্বর মুৎসুদ্দি ও চপলা মুৎসুদ্দি দম্পতির ২ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে সবার জ্যেষ্ঠ সন্তান সুকুমার মুৎসুদ্দি ১৯৩০ সালে ২০ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবে পাড়ার পশ্চিম আন্দার মানিক ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া প্রথম ধাপ অতিক্রম করে নিজ পাড়া থেকে প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে নোয়াপাড়া হাইস্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে মানবিক শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন।
শিক্ষক থেকে পুলিশের চাকুরি: সুকুমার মুৎসুদ্দির পিতা শয্যাশায়ী অবস্থায় ১৯৪৯ সালে প্রয়াত হলে তার আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি। আর্থিক টানপোড়ন মেটাতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির সিঙিনালা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ১৯৪৯ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন তিনি। ৫১ সালের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকতা জীবনের পাঠ চুকিয়ে ৫১ সালের ১৯ নভেম্বর পুর্ব পাকিস্তান পুলিশের রাঙামাটি পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল পদে যোগদান করেন তিনি। ৫৬ সালে সহকারি দারোগা (বর্তমানে) এএসআই বা পুলিশের উপসহকারি পরিদর্শক হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা থেকে বদলী সূত্রে নোয়াখালী জেলা পুলিশ লাইনে রিপোর্ট করেন। একই সালে নোয়াখালীর সেনবাগ থানায় পোস্টিং দেয়া হয় সুকুমার মুৎসুদ্দিকে। ৬৮ সালে একই জেলার হাতিয়া থানায় বদলী হয়ে চলে যান। ৬৯ সালের শেষ দিকে সুকুমার মুৎসুদ্দিকে বেগমগঞ্জ থানায় বদলী করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সুকুমার মুৎসুদ্দির সক্রিয় অংশগ্রহণ: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় ওসি মগবুল হোসেন চৌধুরীর অধীনে দায়িত্বরত অবস্থায় ৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত কুমিল্লার বাগমারা হতে বেগমগঞ্জ থানা সদর পর্যন্ত অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সাথে পাক সেনাদের প্রতিরোধ সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন সুকুমার মুৎসুদ্দি। ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে ওসি মগবুল হোসেন চৌধুরী, দারোগা গোলাম নবী, সহকারি দারোগা সুকুমার মুৎসুদ্দি, ফারুক হোসেন, আফতাব উদ্দিন, কন্সটেবল মনহরি বড়–য়া, দিল মোহাম্মদ, রফিকসহ আরো ১৫ পুলিশ সদস্যরা পাক সেনাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কৌশল অবলম্বন করে সকল পুলিশ সদস্যরা যে যার মত থানা ছেড়ে চলে যান। সেদিন ওসি মগবুল হোসেনের নিকট হাজির হয়ে সহকারি দারোগা সুকুমার বাবু পরবর্তীতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি জানিয়ে দেন, দেশকে রক্ষা করতে হলে যে যার মত, যেভাবে পারেন দ্রুত থানা ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
ওসির কথা মতো দারোগা সুকুমার নিজস্ব ৯০ সিসি হোন্ডা মোটরসাইকেল যোগে ফেনীর পথে রওয়ানা হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে। এক পর্যায়ে ২২ এপ্রিল সন্ধায় ফেনী থানায় পৌঁছলে থানায় থাকা কর্তব্যরত কন্সস্টেবল জানায়, থানার সকল অফিসার ও সদস্যগণ ফেনী হাসপাতালে রয়েছেন। কালবিলম্ব না করে সুকুমার বাবু থানা থেকে হাসপাতালে পৌঁছেন।
ওই রাতে হসপিটালে ফেনীর ওসি মোহাম্মদ আলী ও দারোগা শামছুল আলম চৌধুরীকে বেগমগঞ্জ থানার পুরিস্থিতি জানিয়ে রাত ৯টার দিকে ফেনী থেকে ফের পরশুরাম থানায় তিনি হাজির হন। পরশুরাম থানার ওসি মোঃ ছানবী ও দারোগা মুখলেছুর রহমানকে আবারো বেগমগঞ্জ ও ফেনী থানার পরিস্থিতি জানান। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত পরশুরাম থানায় থাকার পর ওইদিন সকালে ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে দিয়ে ভারত মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার হরিণায় যোগদান করেন সুকুমার। হরিণায় ট্রেনিং সেন্টারে সেদিন কয়েকজন ইপিআর ও পুলিশ সদস্য ও বেসামরিক লোকজন সংগঠিত হতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিলোনিয়ার সাবরুম থানা ও আগরতলা যাবার শান্তির বাজার ১নং সেক্টরের অধিনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় মহকুমায় তখনো পাক সেনারা এসে পৌঁছায়নি। এ খবর জেনে তাৎক্ষণিকভাবে হোন্ডা নিয়ে রামগড়ে আসনে সুকুমার বাবু। রামগড়ের ওসি মতিউর রহমাসের সাথে সাক্ষাত করে তার নির্দেশনা মত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের কাজ শুরু করেন তিনি ওদিনই।
সহোদর সুনীল মুৎসুদ্দির আত্মত্যাগ: এদিকে বড়ভাই সুকুমর মুৎসুদ্দি যখন দেশ রক্ষায় মরিয়া, ঠিক সে সময় তার সহোদর ছোট ভাই সুনীল কুমার মুৎসুদ্দিও দেশ রক্ষার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তৎকালীন রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাগণের খাবার ও রসদ পৌঁছে দিতে গেলে ২৪ এপ্রিল ৭১ কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই লেকে পাক সেনাদের বুলেট বিদ্ধ হয়ে রাঙামাটির বীর সন্তান হিসাবে প্রথম শহীদ হন। নববধুর গর্ভে ৫ মাসের গর্ভজাত সন্তানকে রেখে স্ত্রী স্বপ্না মুৎসুদ্দিকে বাড়িতে রেখে সে সময় মুক্তিযোদ্ধে চলে যান সুনীল কুমার মুৎসুদ্দি। যুদ্ধ চলাকালেই জন্ম নেয় প্রয়াত সুনীলের একমাত্র কন্যা সন্তান রক্তিমা মুৎসুদ্দি।
মুক্তিযুদ্ধে বড় ভাই সুকুমার মুৎসুদ্দির ত্যাগ ও ফের রণক্ষেত্রে বীরত্বগাঁথা ভূমিকা: গর্ভবতী নববধুকে রেখে ছোট ভাইয়ের গর্ভজাত সন্তানের পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই শহীদ হবার খবর বড়ভাই সুকুমার মুৎসুদ্দীর কানে শরণার্থীরা পৌছালেও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসার জন্য তার মন সায় দেয়নি। ভাই হারানোর কষ্ট ও শোককে শক্তিত্বে পরিণত করে আবারো স্বাধিন বাংলাদেশ গড়তে ২৭ এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন কাদের নেতৃত্বে ১২০ থেকে ১২৫ জন ইপিআর, পুলিশ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর সদস্যদের নিয়ে মহালছড়ি থানার মাইজছড়িতে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে ডিফেন্স নেন সুকুমার বাবু। মাইজছড়িতে ২৮ এপ্রিল পাক বাহিনী ও তাদের মিত্র লুসাই বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাগণের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ প্রায় দুপুর পর্যন্ত গড়ালে বহু পাক ও তাদের মিত্র লুসাইরা মারা যায়।
এদিকে ক্যাপ্টেন কাদের পাকিদের নিকট থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ আনতে গিয়ে বুকে বুলেটবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ক্যাপ্টেন কাদেরকে কাঁধে বহন করে রামগড় নিয়ে আসার পথে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। পরে ওদিন সন্ধ্যায় মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাাদায় রামগড় বাজারের সড়কের পূর্বপাশে সমাহিত করেন সুকুমার বাবু ও সঙ্গীয় যোদ্ধাগণ। ওই সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধাগণ যে যার মত অন্যান্য স্থানে পুনরায় যুদ্ধ করার জন্য দলছুঁট হলেও ফের সুকুমার বাবু রামগড় থানায় ওসি মতিউরের নিকট গিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। সুকুমার বাবু ২৮ এপ্রিল রাত থেকে ২ মে পর্যন্ত রামগড় থানাতেই অবস্থান করেন। ২ মে ভোরের সূর্য উঠার সাথে সাথে চট্টগ্রামের করের হাঁট, ফটিকছড়ির বাগান বাজারের দক্ষিণ দিক এবং মানিকছড়ির দিক থেকে ত্রিমুখি আক্রমণ করে বসে পাক সেনারা রামগড় এলাকায়। সেদিন ওসি মতিউরের নেতৃত্বে সুকুমার বাবু, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, অন্যান্য পুলিশ সদস্য, ইপিআর সদস্যরা যৌথভাবে সারাদিন তুমুল প্রতিরোধের মুখে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠিকে থাকার পর অস্ত্র গোলাবারুদ না থাকায় প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ জন্য বীরযোদ্ধা কৌশলগত কারণে থানা ছাড়লেও পাক সেনারা যাতে রামগড়ে অবস্থান ও স্থাপনা দখল করে ঘাঁটি তৈরি না করতে পারে, সে জন্য থানার কাঁচা বাসাবাড়ি, হাইস্কুল ও বাজার আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়ে রাতে আঁধারে ফেনী নদী অতিক্রম করে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম নিবাসি আশুতোষ বসাকের বাড়িতে উঠেন সুকুমার বাবুসহ সঙ্গীয় যোদ্ধারা। সেই রাতে সুকুমার বাবুর সাথে অমরেন্দ্র নাথ চাকমা, প্রিয়লাল বরুয়া, ইপিআরের নুরন্নবী, আক্তার হোসেনসহ আরো অনেকেই আশ্রয় নেন আশুতোষ বাসাকের বাড়িতে। পরদিন ৩ মে ৭১ ভোরের আলো ফুঁটে উঠার সাথে সাথে আশ্রয়স্থল ছেড়ে ভারতের সাবরুমের ছোট হরিণার ট্রেনিং সেন্টারে সকলেই পৌঁছে যান। ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছার পর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এলএমজি, গ্রেনেড ছোঁড়া ও গেরিলা হামলার ট্রেনিং নিতে থাকেন সুকুমার বাবু ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ। দু’দিনের প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে ছোট ছোট অবজারভেশন ক্যাম্প গঠন করা হলে সে সব ক্যাম্পের মধ্যে শিলছড়ি ক্যাম্পে ৫ থেকে ৭ জন পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও ছাত্রদের সমন্বয়ে পাক বাহিনীর প্রতিরোধে অবস্থান নেন সুকুমার বাবু ও তার সঙ্গীয় ফোর্স। পরবর্তী নভেম্বরের ১৫ থেকে ১৬ তারিখ মুজিবনগর সরকারের সাউথ ইস্ট জোনের পুলিশ পরিদর্শক মিঃ তালুকদার ৩শত টাকা সাবস্টেনশিয়াল এ্যালাউন্স ওই ক্যাম্পে প্রত্যেকের হাতে শিলছড়ি ক্যাম্পে পৌঁছে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরে দায়িত্বপালন: ২৫ নভেম্বর সাউথ ইস্ট জোন ওয়ানের পুলিশ অফিসার মিঃ বি দেওয়ান চিঠির মাধ্যমে সুকুমার বাবু ও অমরেন্দ্রনাথ চাকমাকে সাউথ ইস্ট জোনের অফিসে যাবার নির্দেশনা পত্র প্রেরণ করলে ২৭ নভেম্বর সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অধিনে দায়িত্ব পালনের জন্য শান্তির বাজারের হাজির হন সুকুমার বাবু ও সঙ্গিয় বীর যোদ্ধারা তারা। ৩০ নভেম্বর সুকুমার বাবুকে ৬’শ টাকা বেতন এবং ৬’শ টাকা শীতকালীন এ্যালাউন্স দিয়ে দারোগা নজির আহমদ, হাবিলদার মীর আহমদ ও সঙ্গীয় ৬ সিপাহীসহ তৎকালীন ফেনী মহকুমার অন্তর্গত পরশুরাম থানায় যোগদানের জন্য সহকারি দারোগা সুকুমার বাবুকে অফিসিয়াল নির্দেশনা দেয়া হয়। যার অর্ডার নং-এসইজেড-ওয়ান (১)/পি/২০০(১০)। তারিখ ৩০ নভেম্বর ১৯৭১ ইং। ৩০ নভেম্বর বেলা আড়াইটার দিকে ফেনীর তৎকালীন এমপি খাজা আহম্মদের সাথে প্রথম সাক্ষাত করলে তিনি প্রত্যেককে একটি করে কম্বল, একটি করে খাকি শার্ট-প্যান্ট ও একটি করে কিস্তি টুপি দিয়ে দুপুরের আহার করিয়ে থানায় চলে যেতে বললে ওই দিন বিকেলে বেঙ্গল রেজিমেমেন্টর ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (দেশে স্বাধিনের পর সাবেক পাটমন্ত্রী) সুকুমার বাবু ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদেরকে পায়ে হেঁটে পরশুরাম থানায় পৌঁছে দেন।
মুজিবনগর সরকার স্বীকৃত প্রথম থানায় যোগদান ও পতাকা উক্তোলন: মুজিবনগর সরকারের প্রথম থানা হিসাবে ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সুকুমার বাবু পরশুরাম থানায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উক্তোলন করে সঙ্গী ফোর্সদের নিয়ে গার্ড অব অনার প্রধান করেন। ইতিহাসে সেদিন থেকেই মুজিবনগর সরকারের প্রথম থানা হিসাবে পরশুরাম থানার কার্যক্রম শুরু হয়।
ওসি হিসাবে পদোন্নতি ও সোনাগাজী থানায় যোগদান-অবসর গ্রহণ: ১৩ ডিসেম্বর ৭১ সাউথ ইস্ট জোনের অর্ডার নং-এইজেড-ওয়ান(১)/পি/২৫১(১৬) মূলে সহকারি দারোগা থেকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ওসি হিসাবে ফেনীর সোনাগাজী থানায় বদলী করা হলে ওই অর্ডার ১৪ ডিসেম্বর হাতে পৌঁছোর পর ১৫ ডিসেম্বর পায়ে হেঁটে ফেনী হয়ে ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে সোনাগাজী থানায় যোগদান করে তৎকালীন থানায় থাকা ভারপ্রাপ্ত ওসি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নিকট থেকে ওসির দায়িত্বভার বুঝে নেন সুকুমার মুৎসুদ্দি। সোনাগাজী থানার ৬নং ইউনিয়নের বিসিএনবিতে (ভিলেজ ক্রাইম নোট বুক) যা বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেন সুকুমার বাবু। এআইজি ঢাকা-বাংলাদেশ অর্ডার নং-জিএ ৭০-৭৩/৫৯৯(৩৫) তারিখ ৩ এপ্রিল ১৯৭৩ ইং মূলে ১৪ মে ১৯৭৩ তারিখে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের ইতিবৃত্ত লিখিত আকারে আরও (রিজার্ভ অফিসার) মাধ্যমে পুলিশ সুপার নোয়াখালীর নিকট পেশ করেন। পরবর্তীতে নোয়াখালী জেলা সদর সুধারাম, রামগতি, কোম্পানীগঞ্জ ও পরশুরাম থানাসহ বিভিন্ন থানায় ওসির দায়িত্বপালন কালে ১৯৮৮ সালের মে মাসের ২০ তারিখে অবসরে আসেন ওসি সুকুমার মুৎসুদ্দি।
মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র-স্বীকৃতি পেতে ৪৫ বছর গড়াতে চলল সুকুমার মুৎসুদ্দির: এদিকে সুকুমার মুৎসুদ্দির প্রবল আত্মবিশ^াস ছিল একদিন পুলিশ বিভাগই দাপ্তরিকভাবে তার মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা সদনপত্র পেতে সর্বাত্মক ভাবে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে তার দীর্ঘ ৪৫ বছর গড়াতে গড়াতে কেটেছে, তবুও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ পত্রটুকু। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডঃ মুনতাসীর মামুন সুকুমার মুৎসুদ্দির মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় তাকে পত্র দিয়ে অনুরোধ করেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কাজে সহযোগিতা করতে। এমনকি সে আলোকে সুকুমার মুৎসুদ্দির মুুিক্তযুদ্ধে বীরত্বগাঁথা সক্রিয় ভূমিকা ও আত্মত্যাগের কথাও লিপিবদ্ধ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র পেতে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর নোয়াখালী পুলিশ সুপারের নিকট স্ব-শরীরে হাজির হয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভূক্তির আবেদন করেন সুকুমার বাবু। এরপর অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রীর বরাবর ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর আরো একটি আবেদন করেন তিনি। যার ডকেট নং-জামুকা ২২২৮১।
২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি নোয়াখালী পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এসএসপি হেডকোয়ার্টার তলব করেন সুকুমার মুৎসুদ্দিকে। নির্ধারিত তারিখে সাক্ষাত করে রিজার্ভ অফিসার (আরও) মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তৎকালীন সাউথ ইস্ট জোনে নির্দেশনা পত্র, মুজিবনগর সরকারের পুলিশের পদোন্নতি পত্র, মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের আইডি কার্ডসহ যাবতীয় কাগজপত্র দাখিল করেন। যাবতীয় তথ্যাদী ও কাগজপত্র আরও’র উপস্থিতিতে তৎকালীন এসএসপি হেডকোয়ার্টার জসীম উদ্দিন চৌধুরী গ্রহণ পুর্বক সুকুমার বাবুকে আশ^াস দেন মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ পূর্বক গোটা পুলিশ বিভাগের জন্য যে অর্জন ও সুনাম বয়ে এনেছেন, তার জন্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করতে প্রয়েজনীয় সব রকমের ব্যস্থা নেয়া হবে।
ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি যা বললেন: ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোঃ হুমায়ুন কবিরের নিকট (অব: ওসি) সুকুমার মুৎসুদ্দির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার থানায় ওনার বোর্ডে ৮২ সাল থেকে ওসিগণের দায়িত্বকাল পর্যন্ত তালিকা লিপিবদ্ধ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ৭১ সাল থেকে ৮১ সাল কিংবা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কোন ওসির দায়িত্বকালের রেকর্ডপত্র বর্তমানে সোনাগাজী থানায় নেই।
ফেনীর পরশুরাম থানার ওসির বক্তব্য: সাবেক নোয়াখালী জেলা ও বর্তমানে ফেনীর পরশুরাম থানার ওসি মোঃ আবুল কাসেম চৌধুরী বলেন, পরশুরাম থানা ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মুজিবনগর সরকারের সময় এ থানার কী অবস্থা ছিল কিংবা সে সময় কে বা কারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। তিনি আরো বলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়ে নোয়াখালী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে তথ্যাদি থাকতে পারে, তিনি সেখানে যোগাযোগ করতে বললেন।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের বক্তব্য: নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মোঃ ইলিয়াস শরীফ বলেন, সুকুমার মুৎসদ্দির মুক্তিযুদ্ধকালনীন সময়ে কোন রেকর্ডপত্র নোয়াখালী পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সংগ্রহে আপাতত নেই। এ ব্যাপারে ফেনী পুলিশ সুপারের সাথে তিনি এ প্রতিবেদকে যোগাযোগ করতে বললেন।
ফেনী পুলিশ সুপারের বক্তব্য: ফেনীর পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য জানতে রবিবার সরকারি মুঠোফোনে কল করলেও তিনি এ বিষয়ে পরবর্তীতে জেনে গণমাধ্যমকে জানানোর আশ^াস প্রদান করেন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফেনীর পরশুরাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডারের নিকট রবিবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেনীর তৎকালীন এমপি খাঁজা আহমদ (বর্তমানে প্রয়াত) ও আমিনুল করিম মজুমদার ওরফে খোকা মিয়া (প্রয়াত) মূলত পরশুরাম এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক লোকজনকে সংগঠিত করণ ও মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং-এ পাঠানোর জন্য বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনাসহ সব ধরণের দায়িত্বপালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার হিসাবে তৎকালীন সেনাবাহিনীর লে. কর্ণেল জাফর ইমাম (বর্তমানে অব:) ওই এলাকার পাক সেনাদের প্রতিরোধ ও সব কটি প্রতিরোধ যুদ্ধে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামীলীগের মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসাবে মাওলানা আজিজুল হক মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমিনুল করিম মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্বপালনে সক্রিয় ছিলেন। সে সেময় ২নং সাব সেক্টরের একজন সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন জানিয়ে হুমায়ুন শাহরিয়ার আরো বলেন, মূলত পরশুরাম এলাকা ১নং সেক্টর ও ২নং সেক্টর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হত। পরশুরাম ৭ নভেম্বর ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হলে ১ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকারের প্রথম থানা হিসাবে সেই থানাতেই প্রথম পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উক্তোলন করা হয়, কিন্তু সে সময় পুলিশ অফিসার ও সৈনিক হিসাবে কে বা কারা দায়িত্ব ছিলেন তা এই মুহুর্তে আমি স্মরণ করতে পারছি না।
শহীদ পরিবারের সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার মুৎসুদ্দির অন্তিম ইচ্ছ: বয়সের ভারে ন্যুজ প্রায় ৯০ বছর বয়সী শহীদ পরিবারের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসি (অব) সুকুমার মুৎসুদ্দির অন্তিম ইচ্ছার কথা জানাতে গিয়ে বেশ কিছুটা বিরক্তি ও অনিহা প্রকাশ করলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য তুলে ধরার ফাঁকে ফাঁকে অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, আমি আর ক’দিন ই বা বাঁচব! আমার ভাই তার নববধু ও অনাগত সন্তানকে রেখে দেশের টানে মুক্তিযোদ্ধে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হল, আমিও আমার স্ত্রী প্রয়াত মল্লিকা মুৎসুদ্দি চার ছেলে ২ কন্যা সন্তানকে বাড়িতে রেখে পরিবার-পরিজন, সুখ সুবিধার কথা চিন্তা না করে পুলিশের চাকুরিরত অবস্থায় যুদ্ধে গেলাম, যুদ্ধ করলাম, মুজিবনগর সরকারের প্রথম স্বীকৃত থানার সহকারি দারোগার দায়িতও¡ পালন করলাম, বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকাও সঙ্গীয়দের নিয়ে প্রথম উক্তোলন করলাম, সে থানায় কিন্তু আমার ভাগ্যে গত ৪৫ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বা সনদপত্রটুকু জুটেনি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, রাঙামাটি শহরে বিজয় দিবস, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস এলেও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের জন্য শহীদ পরিবারের সদস্য হিসাবে ডাক পড়ে আমার। আমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি, সেখানে গিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাগণ ও আমার ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকড়ে ডুকড়ে কাঁদি, অনুষ্ঠান শেষে মাথাটা নিচু করে বার্ধক্যে কাবু হয়ে থাকা শরীরটা নিয়ে বের হয়ে আসি। আমি মুক্তিযোদ্ধে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণ করে ভাইকে হারিয়েও কেন আজো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সনদের জন্য জাতীর সামনে নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয় তুলে ধরতে পারছিনা গত ৪৫ বছর ধরে? আমি তো ভাতার জন্য কিংবা সরকারি সহায়তা পাবার জন্য মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বা সনদপত্র দাবি করিনি, চেয়েছি আর সবার ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদানটুকুর জন্য স্বীকৃতি ও শেষ বয়সে রাষ্ট্রীয় সম্মানটুকু নিয়ে ওপারে যেতে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ বিষযকমন্ত্রী ও পুলিশ বিভাগের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই বয়সে (৯০) আমি শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, স্ত্রীও প্রয়াত হয়েছে ৫ বছর পূর্বে, আমি আর কার কাছে যাব, কতবার যাব একটি সনদপত্রের জন্য মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাবার জন্য? আমি কী মুক্তিযোদ্ধা না?
তথ্য ও ছবি: হাবিব সরোয়ার আজাদ, সাংবাদিক, উপ-পরিচালক, পরিবেশ ও মানবাধিকার উন্নয়ন সোসাইটি, ঢাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com