শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১১ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: পাসপোর্ট তৈরিতে দুর্নীতির পেছনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সত্যায়ন ও পুলিশ ভেরিফিকেশন মূল কারণ উল্লেখ করে মানুষের হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধে পাসপোর্ট আবেদনে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং সত্যায়ন ও প্রত্যায়নের প্রয়োজন নেই বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য এসবি পুলিশকে জনপ্রতি ৭৯৭ টাকা ঘুষ দিতে হয় বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। সোমবার পাসপোর্ট সেবার ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের এ তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে টিআইবি মিলনায়তনে গবেষক শাহনূর রহমানের এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন। ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতা ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ দিয়ে, ২৭ শতাংশ অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের কারণে এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ গ্রাহক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নতুন পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ পুলিশি তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন। ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ আবেদনকারী ভেরিফিকেশনের জন্য এসবি পুলিশকে ঘুষ দিচ্ছেন। টাকার অংকে ঘুষের পরিমাণ জনপ্রতি ৭৯৭ টাকা। এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের সেবা পেতে একজন আবেদনকারীকে গড়ে ২ হাজার ২২১ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এছাড়াও পুলিশ ভেরিফিকেশনে আবেদনপত্রের ত্রুটি বের করার চেষ্টা, জঙ্গি কার্যক্রম ও অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ভয় দেখানো, বাড়িতে না এসে চায়ের দোকানে ডেকে পাঠানো, ঘুষ দাবি ও ক্ষেত্র বিশেষে বিকাশের মাধ্যমে টাকা চেয়ে পাঠায় পুলিশ-এমন তথ্য রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, গ্রাহকের তথ্য যাচাইয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম তুলে দেওয়ার পক্ষে পুলিশসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ সম্মত রয়েছেন। কিন্তু আরেক অংশ এই নিয়ম বহাল রাখতে চান। এ কারণে ভেরিফিকেশন প্রথা তুলে দেওয়া যাচ্ছেনা। গবেষণায় সত্যায়নকারী কর্তৃক সত্যায়নের ক্ষমতাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা তুলে ধরা হয়।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের হয়রানি বন্ধে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও সত্যায়নের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবির সার্বিক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পাসপোর্ট সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে শতকরা ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সাধারণ মানুষ আবেদনপত্র উত্তোলন ও জমাদান ও প্রি-এনরোলমেন্ট, বায়ো-এনরোলমেন্ট, পাসপোর্ট বিতরণ ও দালালের সঙ্গে চুক্তি বাবদ নানভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।
পাসপোর্ট অফিস থেকে দেওয়া স্লিপে উল্লেখ করা নির্ধারিত সময়ে অনেকেই পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। ২৭ শতাংশ মানুষ বলছেন, পাসপোর্ট পেতে তাদের অতিরিক্ত ১২ দিন সময় লেগেছে। আর ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ পাসপোর্ট তৈরির জন্য দালাল বা অন্যান্যদের সাহায্য নিয়েছেন। এই ৪১ শতাংশের মধ্যে শুধু দালালের সহায়তা নেন অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ। তবে পাসপোর্ট তৈরিতে দালালের সহায়তা নেওয়ার হার হার সবচেয়ে বেশি সিলেটে, ৬০ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম রাজশাহীতে, ২০ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের তুলনায় বর্তমানে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনও হয়েছে। বর্তমান গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাসপোর্টে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখনও পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিদেশগামী শ্রমিকরাসহ সাধারণ মানুষ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে, পাসপোর্ট নবায়নের মেয়াদ ১০ বছর করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, বর্তমানে ৫ বছর পর পর পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে গ্রাহকদের দুর্নীতির শিকার হতে হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ বছর করা হলে এমনিতেই দুর্নীতি কমে যাবে। পাসপোর্টের এসম অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গত ৮ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১ হাজার ৪৫৩ জন সেবাগ্রহীতাদের ওপর জরিপ করা হয়।
এর আগে ২০১৪-১৫ সালে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ-২০১৫’ শীর্ষক জরিপে পাসপোর্ট সেবা সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতের মধ্যে পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৭৭ দশমিক ৭ ভাগ অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হন এবং ৭৬ দশমিক ১ ভাগ ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ দিয়ে থাকেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে পাসপোর্ট সেবা জনমুখী ও সহজ করার জন্য সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ অনেকক্ষেত্রেই টিআইবির ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১৫’ শীর্ষক জরিপের সুপারিশমালার সঙ্গে মিল রয়েছে বলেও জানায় টিআইবি।