মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১

৪৬ মাসে দেশে আত্মহত্যা ৩,৯,৬০০

আমার সুরমা ডটকমঠাকুরগাঁও শহরের কলেজপাড়া এলাকার তরুণী প্রত্যাশা। তার সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠে তন্ময় তানজিম নামের এক তরুণের। তারা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে চ্যাটিং-এর মাধ্যমে আলাপ করতেন। ২৯শে জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “সব বলা হয়তো শেষ হয় না। অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস (কেউ কমেন্ট করবেন না প্লিজ)। এরকম একটি স্ট্যাটাস দিয়ে প্রত্যাশা ঘুমের ওষুধ খেয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
তার আত্মহত্যার কয়েকদিন পর ঠাকুরগাঁও শহরের গোয়ালপাড়া এলাকায় তন্ময় তানজিমও ফেসবুকে “আমি তোমাকে অনেক মিস করছি, তুমি জানতে আমি একটু পাগল টাইপের, তুমি তো মানিয়ে নিতে পারতে। তোমার নাম্বারটাও আমি রেগে ডিলিট করে দেই, কিন্তু আমি সত্যি তোমাকে অনেক মিস করছি” স্ট্যাটাস দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। শুধু তাই নয়, রাজশাহীর বাঘার সোহান আলী। উপজেলার খানপুর জেপি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। খানপুর পূর্বপাড়া এলাকার আশ্রাব আলীর ছেলে। ৩০শে অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নিজ ঘরের তীরের সঙ্গে ঝুলন্ত মরদেহ দেখতে পায় তার পরিবারের লোকজন। নিহত ছাত্রের মা শাহিদা বেগম জানান, সোহান ওইদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে। সকাল ৭টায় প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি এসে তার শয়নকক্ষে পড়তে বসে। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোহানকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে তাকে নামিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঠিক এভাবেই আত্মহত্যা করছে মানুষ প্রতিদিন। গলায় ফাঁস দিয়ে অথবা বিষ খেয়ে। ঝরে যাচ্ছে হাজারো তাজা প্রাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, কলহসহ নানা কারণেই মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, আত্মহত্যার প্রবণতার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। কিন্তু ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী সারা দেশে গত ৪৬ মাসে আত্মহত্যা করেছে ৩৯৬০০ জন। এরমধ্যে ২০১৪ সালে ১০ হাজার ২০০, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০, ২০১৬ সালে ১০ হাজার ৬০০ ও ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৮ হাজার ২০০ জন আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৬ হাজার ৭০০ জন ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ হাজার ৫০০, ২০১৫ সালে গলায় ফাঁসি দিয়ে ৭ হাজার ১০০ ও বিষ খেয়ে ৩ হাজার ৪০০, ২০১৬ সালে গলায় ফাঁসি দিয়ে ৭ হাজার ২০০ ও বিষ খেয়ে ৩ হাজার ৪০০ এবং ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গলায় ফাঁসি দিয়ে ৫ হাজার ৬০০ ও বিষ খেয়ে ২ হাজার ৬০০ নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে। এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক আলম বলেন, বাংলাদেশে ১ লাখ মানুষের মধ্যে বছরে ৮ থেকে ১০ জন লোক আত্মহত্যা করে। বিদেশে সাধারণত বয়স্ক পুরুষরা আত্মহত্যা করে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ তার উল্টো। এখানে কম বয়সী নারীরাই বেশি আত্মহত্যা করে। তিনি বলেন, দেশে আত্মহত্যার মূল কারণ হলো যারা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক বা সহ্যহীন কোনো জটিল রোগে (ক্যানসার, এইডস বা অন্যকোনো ব্যথাযুক্ত) ভুগছেন। এছাড়া মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, প্রেমে পড়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়া, ইন্টারনেট আসক্তি, পরীক্ষায় ফেল করার কারণে আত্মহত্যা করে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের ঝিনাইদহ ও যশোরে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সেখানে ১ লাখ লোকের মধ্যে বছরে ২৮ থেকে ৩০ জন আত্মহত্যা করে। এসব এলাকায় সাধারণত যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক কলহ, সংসারে অশান্তি, দ্রুত বাচ্চা নেয়া, মানসিক অস্থিরতা, নারীদের শিক্ষার হার কম থাকায় সিদ্ধান্ত নেয়ার অক্ষমতার কারণে মানুষ আত্মহত্যা বেশি করে বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামালউদ্দিন বলেন, একজন মানুষের মধ্যে যখন সিরিয়াস ডিপ্রেশন থাকে তখন তার আর বাঁচার ইচ্ছা থাকে না। ডিপ্রেশনের কারণেই পৃথিবীর সব দেশেই আত্মহত্যা করে মানুষ। সেদিক দিয়ে আমাদের দেশও তার বাইরে নয়। বিশেষ করে হতাশা-বিষণ্নতার কারণে মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে। তবে এই হতাশা আর বিষণ্নতার কারণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক কারণেও অনেক সময় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আত্মহত্যা বন্ধের জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। যেসব কারণে সাধারণত আত্মহত্যা করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেসব দিক থেকে দূরে থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, চোখের সামনে যখন কোনো মানুষ দেখে তার সন্তান খারাপ পথে চলে গেছে। স্বামী যখন শুনে স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত অথবা নিজের সন্তান যখন বিয়ের আগেই প্রেগনেন্ট হয়ে যাচ্ছে তখন মানুষ এই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এছাড়া বেশকিছু কারণে যখন মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন আত্মহত্যা ছাড়া সে আর কিছু ভাবতে পারে না। তাই আত্মহত্যা বন্ধে সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে আশা জাগাতে হবে। সুন্দর এই পৃথিবীতে মানুষকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com